আশরাফ জামান ॥
ছেলেবেলায় রোজা থাকার স্মৃতি বার বার মনের আঙিনায় দোলা দিয়ে যায়। আমার বয়স তখন আট-নয় বছর হবে। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। দিনগুলোও ছিল অনেক বড়, তাই আমার বয়সে রোজা রাখা খুব কষ্টের কাজ ছিল।
শেষ রাতে মা ও বড় বোনেরা যখন রান্নার আয়োজন করতেন, তখনই আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমি চুপচাপ ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকতাম। রান্না শেষ হলে আব্বা-আম্মা ও বড় ভাই-বোনেরা যখন মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খেতে বসতেন, আমি তখন ধীরে ধীরে উঠে মুখটা একটু ধুয়ে আব্বার পাশে গিয়ে বসে পড়তাম।
মা নিষেধ করে বলতেন, বাবা কামাল শুয়ে পড় গে যাও। ভেঙে ভেঙে রোজা রাখ। তাছাড়া তোমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ- আজকে শুয়ে পড়। আব্বা হাসতেন। আব্বা হাসলে সাদা দু’পাটির দাঁত চকচক করতো।
বড় ভাই মতিন, বড় বোন রাসু, হাসু সকলে আমার অবস্থা দেখে হাসতেন। সকলে বলতেন, তোমার বয়সের আবুল, সূর্য, সাইফুল, নূরুল আমীন ওরা কেউ তো প্রতিদিন রোজা থাকে না। রোজা রাখ দশ-বারোটা, তাতেই চলবে। তাছাড়া তোমার স্বাস্থ্য খুব খারাপ।
কিন্তু আমি গোঁ ধরে মাথা নিচু করে বসে থাকতাম। কান্নার ভান করতাম। আমার ছোট পিঠাপিঠি বয়সের বোন ছিল মাসু। সে দু’তিন দিন ভেঙে ভেঙে রোজা রাখতো। তাছাড়া ওর স্বাস্থ্য ছিল ভালো। ছোট ভাই জামাল ছিল আমার পাঁচ বছরের ছোট। সে সারা মাসে একটি রোজা করতো।
আমাদের পরিবার ছিল খুব ধার্মিক প্রকৃতির। আব্বা ছিলেন একজন আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদ। পাড়ায় কোনো মসজিদ ছিল না, তাই বাসার বাইরের ঘরে আমরা ফজরে বা কখনো এশার নামাজ জামাতে পড়তাম। আমরা তিন ভাই, আমাদের গৃহশিক্ষক দোকানের ম্যানেজার পেছনে দাঁড়াতাম। আব্বা নামাজে ইমামতি করতেন। আশপাশের বাসার কেউ কেউ আসতেন। ফজরের নামাজের পর আব্বা কুরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা দিতেন।
মাসলা-মাসায়েলের তালিম আমাদের শোনাতেন। আমরা নিয়মিত ভাই-বোনেরা আব্বার কাছে কুরআন পড়া শিখতাম। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে এসে কুরআন পড়া শিক্ষা করতো।
শেষ রাতে আমি যখন আব্বার পাশে বসে পড়তাম, তখন আব্বা বলতেন, কামালকে ভাত খেতে দাও। গরম ভাত খাক নইলে সকালে রোজা ভেঙে ফেল বাবা। বড় হয়ে সব রোজা করবে কেমন?
আমি মাথা নেড়ে স্বীকার করতাম। কিন্তু আমার মা জানতেন, একবার খেতে পারলে হয়, জান গেলেও রোজা ভাঙতো না। জামালও মাঝে মাঝে সাহরী খেতে উঠতো।
আব্বা বলতেন, তুমি প্রতিদিন তিনটি রোজা করবে।
জামাল মাথা নেড়ে সায় দিত। সারা দিন রোজা রেখে কাতর হয়ে যেতাম। কিন্তু সকলে বসে যখন ইফতার করতাম, তখন খুব ভালো লাগতো।
বন্ধু বয়সের বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে রোজা রাখার সংখ্যা নিয়ে প্রতিযোগিতায় আমি জিতে যেতাম।
আব্বা, চাচারা ও আমার তিন ভাই একত্রে শহরের ঈদগাহ ময়দানে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম নতুন জামা বা পাঞ্জাবি-পায়জামা ও টুপি মাথায় দিয়ে। গায়ে আতর ও চোখে সুরমা লাগাতাম।
আব্বা পরতেন লম্বা শেরওয়ানী, পায়জামা ও জিন্নাহ ক্যাপ। ছয় ফুট লম্বা, ফর্সা ছিলেন আব্বা। মুখে ছিল পাতলা দাড়ি। সব পোশাকে আব্বাকে মানাতো। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আব্বা এবং ছোট চাচাজান দেখতে খুব সুন্দর ও লম্বা ছিলেন। অবশ্য অন্য ভাইয়েরা একটু কম লম্বা ছিলেন।
ঈদের নামাজ শেষ হলে আমরা সকলে রওনা হতাম দাদাবুজির বাসায়।
আমাদের দাদাবুজি ছিলেন সকলের মুরুব্বি। তিনি আলাদা একটি বাসায় থাকতেন। কাজের মহিলা ছিল তার সার্বক্ষণিক সেবা যত্নের জন্য। ঈদের দিন আমার দাদি তার বাসার উঁচু খাটে বসতেন। পা নিচে জলচৌকিতে রাখতেন। পাশে বসতেন পাঁচ ছেলে আমার আব্বা ও চাচারা। কেউ খাটে কেউবা চেয়ারে।
আমরা তিন ভাই ও চাচাদের ছেলেরা সকলে একত্র হয়ে লাইন করে একজন একজন করে প্রথমে দাদি ও অন্য মুরব্বিদের পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি করতাম। কদমবুচি শেষ করে কয়েকটি বেঞ্চে বসতাম।
একটু পরে শুরু হতো কোলাকুলি। সালাম পর্ব শেষ হলে একটু সেমাই খেতাম। চাচাজানরা সকলের খোঁজখবর ও নানাবিধ আলোচনা করতেন। চাচাতো ভাইদের মধ্যে সূর্য, দেলজু, দুলাল কে কতগুলো রোজা রেখেছে, জিজ্ঞেস করলে কেউ দশ-বারোটা রোজা করেছে বলতো। আমার আব্বা হাসিমুখে ঘোষণা দিতেন, আমার কামাল পুরো একমাস রোজা রেখেছে।
মুরুব্বিরা সকলে আমাকে বাহবা জানাতেন। দাদাবুজির বাড়ির পর্ব শেষ হলে আমরা ভাইয়েরা দলবেঁধে রওনা হতাম চাচাদের বাড়িতে ও আমাদের বাড়িতে। তোতা ভাইজানের বাড়িতেও যেতাম।
এভাবেই আমাদের ঈদের আনন্দ উদযাপিত হতো।
Check Also
ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়
দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …