॥ এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্্ফার ॥
ঈদুল ফিতর মুসলিম সমাজের সর্ববৃহৎ জাতীয় উৎসব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলমানদের জন্য মাহে রমজানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা ফরজ করেছেন। এ এক মাস কঠোর আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির ব্রত নিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করাই ছিল মাহে রমজানে ইবাদত-বন্দেগীর প্রধান উদ্দেশ্য। পবিত্র মাহে রমজান যে মানুষকে খাঁটি আল্লাহর বান্দা হবার প্রশিক্ষণ দান করে থাকে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। মানুষ পৃথিবীর প্রচলিত মিথ্যাচার ও অন্যায়-অবিচারে লিপ্ত থাকে আর মাহে রমজান এগুলো থেকে মানুষকে উদ্ধার করে তাকওয়া ধৈর্য, সহমর্মিতাসহ যাবতীয় মানবিক গুণাবলিতে বলীয়ান হবার এক বিরল প্রশিক্ষণের বিষয় হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের নিকট আগমন করে থাকে। এ মর্মে মহানবী (সা.)-এর একটি বিখ্যাত হাদীস এভাবে এসেছে, ‘আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, সাওম পালন করে কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ না করে, তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (সহীহ আল বুখারী)। রাসূল (সা.)-এর এ ঘোষণা থেকে জানা যায় যে, এ রমজান মাস শুধু ফজিলত পূর্ণই নয়, এটা একটা অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মাস। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর যেসব হাদীস রয়েছে, তার মধ্যে একটি এ রকম ‘আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, রমজান মাস শুরু হলে আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকল লাগিয়ে বন্দী করা হয়।’ (সহীহ আল বুখারী)। এভাবে রমজান মাসে লাইলাতুল কদর অর্থাৎ মর্যাদার রাত্রি, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম, যাকে পাবার জন্য মসজিদে রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করতে হয়। এ সব ফাজায়েলসহ যে বিষয়টি রমজানকে সবচেয়ে সর্বাধিক বরকতময় করেছে, তা হলো এ মাসেই বিশ্বমানবতার মুক্তির সনদ আসমানী বিধান মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘রমজান এমন একটি মাস যে মাসে কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা স্পষ্ট হিদায়াত ও শিক্ষায় পরিপূর্ণ, যা হিদায়েতের পথপ্রদর্শক এবং হক ও বাতিলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য সূচনাকারী …।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। এই মহাসম্মানিত একটি মাসকে বিদায় জানানোর জন্য অবশ্যই একটি স্মরণযোগ্য আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন রয়েছে বৈকি? মাহে রমজানকে পূর্ণ এক বছরের জন্য বিদায়ের যে আনুষ্ঠানিকতা, তা মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)ই ঘোষণা করেছেন, আর তা হলো ঈদুল ফিতরের উৎসব। ঈদুল ফিতর হলো রমজানের সিয়ামের অবসান অর্থাৎ সবারই পানাহারের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা।
ঈদুল ফিতরের উৎসবে যে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় তার মধ্যে প্রথমত, এদিন মহান রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া হিসেবে দু’রাকাত ওয়াজিব সালাত আদায় করা, যার মধ্যে অতিরিক্ত তাকবীর উচ্চারণের সময় হাত উত্তোলন করা। এ সালাতটি অন্যান্য সালাতের চাইতে এটাই ব্যতিক্রম। এছাড়া ঈদগাহের দিকে যাবার সময় ও ফিরে আসার সময় ‘আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ যে তাকবীর পাঠ করা হয়, এটাতেও মহান রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর প্রশংসাই করা হয়। ঈদুল ফিতরের এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে যে বিষয়টি অতি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে, তা হলো আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা যে আমাদের যথাযথভাবে মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা পালনের তাওফিক দান করেছিলেন, এজন্যই তাঁর দরবারে কৃতজ্ঞ বান্দাদের পক্ষ থেকে লাখকোটি শোকরিয়া। এ সম্পর্কিত একটি হাদীস এভাবে এসেছে ‘ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতরের দু’রাকাত সালাত আদায় করলেন এর পূর্বে কোনো সালাত আদায় করলেন না এবং পরেও না। অতঃপর তিনি বিলাল (রা.)-কে সাথে নিয়ে মহিলাদের নিকট গেলেন এবং তাদেরকে (আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে) দানের জন্য বললেন। তারা তখন দান করতে শুরু করল কেউ দিল আংটি, আবার কেউবা দিল গলার হার।’ (সহীহ আল বুখারী)।
দ্বিতীয়ত, ঈদের দিন শুধু নিছক আনন্দে আত্মহারা হয়ে চলার দিন নয়। এ দিনে আল্লাহর রাসূল (সা.) সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করেছেন। এ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য একটি হাদীস এরকম, ‘হজরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহে যেতেন এবং সেখানে সর্বপ্রথম যে কাজ করতেন, তা হলো সালাত আদায়। সালাত শেষে তিনি লোকদের দিকে ফিরে দাঁড়াতেন এবং তারা নিজ নিজ কাতারে বসে থাকতো। তিনি তাদের উপদেশ দিতেন, অসিয়ত করতেন এবং জরুরি বিষয়ে হুকুম দান করতেন। অতঃপর সেনাবাহিনী গঠন করার ইচ্ছা থাকলে তিনি তাদের মধ্য থেকে লোকদের সেনাবাহিনীর জন্য আলাদা করে নিতেন অথবা কোনো ফরমান জারি করার ইচ্ছা করলে তিনি তা করতেন। এরপর তিনি ফিরে যেতেন। নবী (সা.)-এর পরে (খেলাফাতে রাশেদার আমলেও) এ নিয়মই অনুসরণ করা হতো …।’ (সহীহ আল বুখারী)।
ঈদুল ফিতরের দিন আহার করে মাহে রমজানের সিয়ামের যে পরিসমাপ্তি করতে হয়, তা হাদীস দ্বারা স্বীকৃত। ‘হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসূল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে কিছু না খেয়ে বাইরে বের হতেন না-।’ (সহীহ আল বুখারী)।
তৃতীয় যে বিষয়টা আমি বলতে চাই, তা হলো ঈদুল ফিতরের দিন নির্মল সাংস্কৃতি ও ক্রীড়ার অনুশীলন করাও দোষণীয় নয়। এ প্রসঙ্গে অনেকগুলো হাদীস রয়েছে যেমন ‘হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একবার ঈদের দিনে) আবু বকর এলেন, তখন আনসারদের দুটি মেয়ে আমার নিকট বসে বুআস যুদ্ধের দিনে আনসাররা পরস্পর যা বলছিল, সে সম্পর্কে গীত গাচ্ছিল। তারা পেশাগত গায়িকা ছিল না। আবু বকর (রা.) বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গৃহে শয়তানী বাদ্যযন্ত্র! এটা ঘটেছিল ঈদের দিনে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবু বকর প্রত্যেক জাতির জন্যই ঈদ রয়েছে, আর এ হচ্ছে আমাদের ঈদ।’ (সহীহ আল বুখারী)। এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, ‘ঈদের দিন হাবশীরা বর্শা ও ঢালের খেলা খেলত (অর্থাৎ যুদ্ধকৌশল শিখতো)। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, তুমি কি তাদের খেলা দেখতে চাও? আমি বললাম হ্যাঁ! অতঃপর তিনি আমাকে তাঁর পিছনে এমনভাবে দাঁড় করিয়ে দিলেন …। (সহীহ আল বুখারী)।
চতুর্থ যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তা হলো ঈদুল ফিতর মূলত আত্মবিশ্লেষণ, আত্মজিজ্ঞাসা তথা আত্মসমালোচনার দিন। বিশ্বনবী (সা.)-এর হাদীসে এসেছে- যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে মাহে রমজানের সাওম পালন করেছে তার অতীত জীবনের পাপসমূহকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অন্য হাদীসে এসেছে, যার কাছ থেকে মাহে রমজান বিদায় হলো অথচ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা হলো না, সে ধ্বংস হয়ে যাক। কাজেই ঈদুল ফিতরের দিন বেশি বেশি তাওবা ইসতেগফার পাঠ করে পুনরায় মাহে রমজান পাবার প্রার্থনা আল্লাহর কাছে করা জরুরি। এ প্রসঙ্গে মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর জীবনের একটি ঘটনাকে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ঈদ আনন্দে যোগদান না করে গৃহে বসে ক্রন্দন করছিলেন। অন্যান্য সাহাবীগণ তাঁর এ ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন যে, মাহে রমজান চলে গেল অথচ আমার গুনাহসমূহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ক্ষমা করেছেন কিনা, তা জানতে পারলাম না কাজেই আমি কীভাবে ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করব?
সব শেষে যে কথা বলতে চাই, তা হলো আসুন আমরা ঈদের খুশির দিনে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের ভুলক্রটি সংশোধনের পথে অগ্রসহর হই। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ।
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …