জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে সাতক্ষীরার সুস্বাদু হিমসাগর, গোবিন্দভোগ ও ল্যাংড়া আম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে আসছে। মৌসুমের আগে থেকে বাগান নির্ধারিত করে চাষীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিষমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে আম উৎপাদন করায় বিদেশে সাতক্ষীরার আমের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত কোন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাতক্ষীরার আম ক্রয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কোন চুক্তি করেনি। সে কারণে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ন্যায্য দাম না পাওয়া নিয়ে দুঃচিন্তার মধ্যে পড়েছেন রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনকারি চাষিরা।
তবে সাতক্ষীরা থেকে আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া জানিয়েছে, ইউরোপের কয়েকটি দেশের ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। শিগগির তারা আমবাগান পরিদর্শনে বাংলাদেশে আসতে পারেন। তবে এ-সংক্রান্ত কোনো দিন-তারিখ তারা দেননি।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যানুযায়ী চলতি মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় আম উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার টন, যা গত মৌসুমের তুলনায় ৫ হাজার টন বেশি। গত মৌসুমে জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির আম উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৫ হাজার টন।
সূত্রটি জানায়, জেলায় হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, তোতা, আম্রপালি ও ফজলিসহ অন্তত ১৫ জাতের আম উৎপাদন হয়, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনকারি চাষী সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁকাল এলাকার রফিকুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে তিনি ১০ বিঘা জমিতে হিমসাগর, গোবিন্দভোগ ও ল্যাংড়া আম চাষ করেছেন। তবে অন্য বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে প্রতিটি গাছে আম ধরেছে বেশি। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া সময় অনুযায়ী আগামী ১২ মে গোবিন্দভোগ, ২৫ মে হিমসাগর ও ১ জুন ল্যাংড়া আম গাছ থেকে সংগ্রহ করা যাবে।
তিনি বলেন, নির্ধারিত তারিখের মধ্যে যদি বিদেশী ক্রেতারা আম আমদানির চুক্তি না করে তাহলে দেশীয় বাজারে বিক্রি করতে হবে রপ্তানিযোগ্য আম। তখন ন্যায্য দাম পাওয়া যাবে না।
কলারোয়া উপজেলা সদরের রপ্তানিযোগ্য আমচাষী কবিরুল ইসলাম বলেন, আমি ১৫ বিঘা জমির বাগানে বিভিন্ন জাতের আম চাষ করেছি। এর মধ্যে হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ ও আম্রপালি উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি মৌসুমে বাগানে ফলন খুবই ভালো হয়েছে। আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সলিডারিদের তত্ত্বাবধানে বাগান পরিচর্যা করি। সম্পূর্ণ বিষমুক্ত উপায়ে আমার বাগানে আম উৎপাদন করেছি। এখন ক্রেতারা যদি আমার বাগানের আম আমদানি করেন তাহলে ভালো লাভ হবে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুখরালী গ্রামের আমচাষী খোকা হোসেন বলেন, বিগত ২০/২৫ বছর ধরে আমি বিভিন্ন এলাকায় আম বাগান ক্রয় করি। চলতি মৌসুমেও প্রায় ৪০ লাখ টাকা দিয়ে ১৫/১৬টি আম বাগান কিনেছি। একেকটি বাগানে ৩০/৫০টি গাছ রয়েছে। আম গাছে মুকুল আসার সাথে সাথেই মালিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন দামে এসব বাগান ক্রয় করি। এর পর আম পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিক দিয়ে এসব বাগান পরিচর্যা করি। গত চার/পাঁছ বছরের মধ্যে চলতি মৌসুমে বাগানে সবচেয়ে বেশি আমের ফলন হয়েছে। আবহাওয়া যদি অনুকূলে থাকে তাহলে সব খরচ বাদ দিয়েও ১৫/২০ লাখ টাকা মুনাফা হতে পারে।
আম রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়ার প্রোগ্রাম অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত মৌসুমে ইউরোপের কয়েকটি দেশে সাতক্ষীরা থেকে ২ হাজার ১০০ কেজি আম রপ্তানি করি আমরা। চলতি মৌসুমেও ইতালি, ইংল্যান্ড ও হংকংয়ের কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে সাতক্ষীরার আম রপ্তানি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই ওই ক্রেতারা সাতক্ষীরায় পৌঁছে রপ্তানিযোগ্য আমবাগান পরিদর্শন করে চুক্তি করবেন বলে আশা করছি। এরই মধ্যে সলিডারিদের তদারকিতে ২৯০ একর জমির ৩৫১টি বাগান মালিককে বিষমুক্ত আম উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সলিডারিদের পক্ষ থেকে দেশের বাজারেও সাতক্ষীরার বিষমুক্ত আম সরবরাহ করা হয়।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা কোনো রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনকারী মালিকের সঙ্গে চুক্তি করেনি। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া ও দেবহাটা উপজেলার ৮১টি রপ্তানিযোগ্য আমবাগান প্রস্তুত করা হয়েছে। বিষমুক্ত আম উৎপাদনে এসব বাগানের ৮১ জন আমচাষীকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বিষমুক্ত আম উৎপাদন করেছেন।
এছাড়া জেলার বিভিন্ন জাতের আরো সুস্বাদু ৪৫ হাজার ৫০০ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পাওে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যাবে সাতক্ষীরার আম, ২২৫ কোটি টাকা বিক্রির আশা
অনুকূল আবহাওয়া ও ফলন ভালো হওয়ায় সাতক্ষীরায় চলতি মৌসুমে ২২৫ কোটি টাকার আম বিক্রির কথা জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গত কয়েক বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে আমচাষিদের যথেষ্ট পরিমাণে লোকসান গুনতে হয়েছে। তবে চলতি মৌসুমে কোনো ধরনের ঝড়-বৃষ্টি না হওয়ায় আমের ফলন ভালো হয়েছে। এর ফলে গত কয়েকবারের লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখার আশা করছেন আমচাষিরা।
সাতক্ষীরায় বিভিন্ন জাতের আম চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে হিমসাগর, ল্যাংড়া, গোবিন্দভোগ, আম্রপালি, মল্লিকা, সিঁদুররাঙা, ফজলি, কাঁচামিঠা, বোম্বাই, লতাবোম্বাই উল্লেখযোগ্য।
জানা গেছে, সাতক্ষীরার আমের সুনাম রয়েছে ইউরোপ পর্যন্ত। প্রতিবছর সাতক্ষীরা থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আম ইউরোপে রপ্তানি করা হয়। নবমবারের মতো চলতি বছরও ইতালি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ডে রপ্তানি হবে সাতক্ষীরার আম।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলার চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়লে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হবে সাতক্ষীরার আম। এতে সবমিলিয়ে বিক্রি হবে প্রায় ২২৫ কোটি টাকার আম।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সদর উপজেলায় এক হাজার ২৩৫ হেক্টর, কলারোয়ায় ৬৫৫ হেক্টর, তালায় ৭১৫ হেক্টর, দেবহাটায় ৩৭০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ৮৩৫ হেক্টর, আশাশুনিতে ১৪৫ হেক্টর ও শ্যামনগরের ১৬০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। সবমিলিয়ে চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। জেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত পাঁচ হাজার ২৯৯টি আমবাগান ও ১৩ হাজার ১০০ জন চাষি রয়েছেন। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। যে ফলন হয়েছে, তাতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
সাতক্ষীরার তালা সদরের আমচাষী আব্দুল কাদের জানান, তার ৫ বিঘার হিমসাগর আমের বাগান রয়েছে। গত কয়েক বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ আশানুরূপ দাম না পাওয়ার কারণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে চলতি বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় আর আমের ফলন তুলনামূলক অনেক বেশি হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি লাভের আশা করছেন।
পাটকেলঘাটার জুসখোলা এলাকার আমচাষ মজিদ মাহমুদ জানান, গত কয়েক বছর ফলন ভালো হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। তবে চলতি মৌসুমে আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। বাজার মূল্য সঠিক পেলে এবার তুলনামূলক অনেক লাভ হবে। গত বছর গড়ে হিমসাগর আমের কেজি ৫০ টাকা বিক্রি হয়েছিল। এ বছর আমের আকৃতি অনেক বড় হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমের দাম বৃদ্ধি পাবে।
সাতক্ষীরা শহরের ব্যবসায়ী ঈদ্রিস আলী জানান, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আম বাজারজাতকরণের নির্দিষ্ট সময়সীমা ও তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী অপরিপক্ব আম কেমিক্যাল দিয়ে বাজারজাত করার চেষ্টা করছেন। প্রশাসনের নজরদারিতে কিছু ধরাও পড়ছে। প্রশাসন তৎপর থেকে অপরিপক্ক আম বাজারজাত করা রোধ করতে না পারলে প্রকৃত আম চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি আরও জানান, অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় অপরিপক্ব আম কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রির চেষ্টা করছেন। অসাধু এসব ব্যবসায়ীদের কারণে প্রকৃত আমচাষিদের সুনাম নষ্ট হয়। যেহেতু সাতক্ষীরার আমের সুনাম সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত রয়েছে, সেক্ষেত্রে সুনাম ধরে রাখতে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগকে তৎপর থাকতে হবে। তাছাড়া সর্বক্ষণিক আমের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে না পড়ায় এবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমের মুকুল হয়েছিল। আমের গুটি ধরেছিল অনেক। সে তুলনায় কম পরিমাণে আমের গুটি ঝরেছে। এজন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আম উৎপাদন হবে বলে আশাবাদী।
তিনি জানান, যেহেতু গত কয়েক বছরের তুলনায় আমের ফলন ভালো হয়েছে, সেক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আম উৎপাদন হবে। জেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত পাঁচ হাজার ২৯৯টি আমবাগান ও ১৩ হাজার ১০০ জন চাষি রয়েছেন। ৫০ টাকা কেজি দরে দাম ধরলে ২২৫ কোটি টাকার আম বিক্রি হবে। তাছাড়া এ বছরও ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি করা হবে।
এদিকে, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জাতের আমের বাজারজাতকরণের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী আগামী ১২ মে থেকে গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, বোম্বাই ও গোপালখাসসহ অন্যান্য স্থানীয় আম পাড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ২৫ মে থেকে হিমসাগর, ১ জুন ল্যাংড়া ও ১৫ জুন থেকে আম্রপালি পাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
#