গত বছর যে পরিমাণ জমির ফসল দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় কাটিয়েছি, এবার সেই ফসল আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় কাটাতে হচ্ছে। আবার দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দিতে হচ্ছে -টুকুন কুমার দেব, কৃষক, বানিয়াচং, হবিগঞ্জ
একসময় শুধু দু-তিন বেলা খাবারের বিনিময়ে অন্যের জমিতে কাজ করতেন কৃষি শ্রমিকরা। পরে যুক্ত হয় নামমাত্র মজুরি। সেই মজুরিই বর্তমান বোরো মৌসুমে এলাকাভেদে ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা। তবু অনেক এলাকায় কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
বিভিন্ন জেলা থেকে কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, কৃষি শ্রমিকের সবচেয়ে বেশি মজুরি চট্টগ্রাম ও হাওরাঞ্চলের দুর্গম এলাকাগুলোয়। দৈনিক এক হাজার ২০০ টাকা। চাহিদাভেদে বাড়তি দুই বেলা খাবারও দিতে হয় কোথাও কোথাও।
শ্রমিক খাটানো কৃষকের পাশাপাশি কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সংকটের কারণে অন্য এলাকা থেকে শ্রমিক আনতে হয়। তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা লাগে। আবার দুর্গম এলাকা হওয়ায় হারভেস্টার মেশিন ব্যবহার করা যায় না। এ কারণে শ্রমিকনির্ভর হতে হয় কৃষকদের।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এই বছর চুয়াডাঙ্গায় কৃষি শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে কম। দৈনিক ৪০০ টাকা। এর কারণ হিসেবে কৃষক ও কৃষি কমকর্তারা বলছেন, এই জেলায় বোরোর পাশাপাশি ভুট্টা চাষও হয় ব্যাপক হারে। ভুট্টা কাটা শেষ হয়ে যাওয়ায় জেলায় শ্রমিক সংকট নেই। এ কারণে এখানে শ্রমিকদের দর-কষাকষির সুযোগ কিছুটা কম।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ১০ বছরে কৃষি মজুরি প্রায় আট গুণ বেড়েছে। মজুরি বাড়ার কারণও যৌক্তিক। অকৃষি খাতে শ্রমিকরা বেশি মজুরি পাচ্ছেন। এ কারণেই কৃষিকাজে তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। শ্রমিক সংকটের আরেকটি বড় কারণ গ্রামীণ শ্রমিকদের শহরে বিভিন্ন বড় প্রকল্পের কাজে যুক্ত হওয়া। এসব কাজে দীর্ঘ মেয়াদে শ্রম বিক্রি করা যায়। আবার গ্রামে শিক্ষার ছোঁয়া লাগার কারণেও অনেকে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাটি-পানির কাজে আগ্রহ পাচ্ছেন না।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হাসনীন জাহান জানান, ১৯৯১ সালে দেশে মোট শ্রমিকের প্রায় ৭০ শতাংশ ছিল কৃষি শ্রমিক। এর মধ্যে পুরুষ ছিল ৯১ শতাংশ এবং নারী মাত্র ৯ শতাংশ। আর ২০১০ সালে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৪৮ শতাংশ; যার মধ্যে পুরুষ ৮৫ শতাংশ এবং নারী ১৫ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২০ সালের প্রতিবেদনে কৃষি শ্রমিকের হার মোট শ্রমিকের ৩৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৭৯ শতাংশ এবং নারী ২১ শতাংশ।
অর্থাৎ গত ৩০ বছরের কৃষি শ্রমিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষি শ্রমিক কমেছে। তবে গত ৩০ বছরে কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে পাওয়া যায়নি।
হাওরে মজুরি সবচেয়ে বেশি : হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলা সদরের দত্তপাড়া গ্রামের কৃষক টুকুন কুমার দেব বলেন, ‘গত বছর যে জমি (ফসল) দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকায় কাটিয়েছি, এবার সেই জমি আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায় কাটাতে হচ্ছে। আবার দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দিতে হচ্ছে।’
জাতুকর্ণপাড়া গ্রামের কৃষক ফজল মিয়া জানান, গভীর হাওরের (দূরবর্তী স্থান) তিন কেদার (৩০ শতাংশে এক কেদার) জমি কাটাতে ১৫ মণ ধান দিয়ে ১০ জন শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে খরচ বেড়ে গেছে।
ধান কাটা শ্রমিকদের ব্যাপারে বানিয়াচং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. এনামুল হক বলেন, যেসব গভীর হাওরের যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ, অর্থাৎ যেখানে ধান কাটার মেশিন নেওয়া সম্ভব নয়; সেখানে শ্রমিকের ওপর নির্ভর করতে হয়।
সুনামগঞ্জের হাওরে কৃষি শ্রমিকরা টাকার চেয়ে ধানের বিনিময়ে ধান কাটেন বেশি। দৈনিক গড়ে একজন শ্রমিক প্রায় এক মণ ধান পান। এক একর জমি চাষ করতে কৃষকের প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। ধান পান ৬০ থেকে ৭০ মণ।
কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। ভরা মৌসুমে শ্রমিক সংকট দেখা দিলে আরো বেড়ে যায়। সেখানে এক একর বোরো জমিতে চাষাবাদ করতে খরচ হয় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। প্রতি একরে গড়ে ৭০ মণ ধান উৎপাদন হয়। ফসল কাটা-মাড়াই মৌসুমে ধানের দাম থাকে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। সে হিসাবে কৃষকরা এক একর জমিতে উৎপাদিত আধাপাকা ধান বিক্রি করে পান ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা।
জামালপুর সদরের পুগলই গ্রামের কৃষক মো. ইয়ানুছ আলীর ক্ষেতের বোরো ধান কাটছিলেন শ্রমিক ফয়জুল ইসলাম (৪০)। তিনি এসেছেন মাদারগঞ্জ উপজেলার বাজিতেরপাড়া থেকে। তিনি এসএসসি পাস। স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। তিনি বলেন, ‘এখন তো সার্বিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চলে না। এখানে ৮০০ টাকা মজুরিতে ধান কাটতাছি। এই টাকা দিয়া কী অবো? মাছ, তেল আর আলু কিনতেই চলে যাবে।’
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার কৃষি শ্রমিক রজব আলী বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বেশি। ভালো মজুরি না পেলে কাজ করে পোষায় না। এখনকার সময়ে ৭০০ টাকা কিছুই না।’
চট্টগ্রামের চিত্র : জেলার রাউজান উপজেলার পূর্ব গুজরা ও কদলপুর ইউনিয়নে ৫০০ কানি (৪০ শতাংশে ১ কানি) জমিতে ধান চাষ করেছেন কৃষক পীযূষ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘প্রতিজন শ্রমিকের দৈনিক মুজরি দিতে হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা।’
ইসহাক ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘গত মৌসুমে শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল এক হাজার টাকা। এবার এক হাজার ২০০ টাকা। খাওয়াদাওয়াসহ একজন শ্রমিকের জন্য খরচ পড়ছে প্রায় এক হাজার ৫০০ টাকা। তাহলে ধান পাব কত টাকার?’
রাউজানে শ্রমিক সংকটের কথা স্বীকার করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন বলেন, ‘আগে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার শ্রমিক পাওয়া যেত। এবারে চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে যাঁদের পাওয়া যাচ্ছে, দৈনিক এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে।’
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার আমুচিয়া ইউনিয়নের কনজপাড়ার কৃষক আবদুল জলিল জানান, বগাচরা বিলে ২০ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। ভোলা ও নেত্রকোনা থেকে কয়েকজন শ্রমিক এনে ধান কাটাচ্ছেন। প্রতিজনকে হাজার টাকার ওপর মজুরি দিতে হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গায় সবচেয়ে কম মজুরি : চুয়াডাঙ্গার কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় সাধারণত কৃষি শ্রমিকের মজুরি দৈনিক ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা। বোরো মৌসুমের একেবারে শুরুর দিকে ভুট্টা কাটার কাজও চলছিল। ওই সময় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিয়েও শ্রমিক নিতে হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপট এখন নেই। ভুট্টা কাটা শেষ হওয়ায় শ্রমিক সংকট কমে গেছে। এখন চার-পাঁচজন শ্রমিক জোটবদ্ধভাবে এক বিঘা জমির ধান কেটে দিচ্ছেন এক হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার টাকায়। সেই হিসাবে একজন শ্রমিক ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যান্য এলাকার চিত্র : নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বাগধানা গ্রামের কৃষক সম্ভু মণ্ডল জানান, গতবারের তুলনায় চলতি মৌসুমে ধান চাষে বিঘাপ্রতি প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। অথচ বাজারে ধানের দাম আগের মতোই।
চৌমাশিয়া গ্রামের সাজ্জাদ মণ্ডল জানান, তিনি দুই বিঘা জমির ধান কাটিয়েছেন শ্রমিক দিয়ে। ৫০ মণ ধান পেয়েছেন, এর মধ্যে শ্রমিকরা ঠিকা হিসেবে প্রতি মণে সাত কেজি করে নিয়েছেন।
মহাদেবপুর উপজেলার রসুলপুর (বটতলী) মোড়ে আব্দুর রহিম নামে এক বর্গাচাষি বলেন, ‘জমির মালিক গেরস্তকে সাড়ে ১০ মণ ধান দেওয়ার চুক্তিতে দেড় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করেছি। কাটা-মাড়াই শেষে মোট ধান হয়েছে সাড়ে ৩৩ মণ। তার মধ্যে ধান কাটা শ্রমিক চার মণ ও জমির মালিককে সাড়ে ১০ মণ ধান দেওয়ার পর আমি পেয়েছি ১৯ মণ ধান। আমি খাবারের জন্য চাষ করেছি। বিক্রি করলে আমার খরচ উঠত না।’
কুষ্টিয়ার কৃষকরা জানান, এক একর জমিতে ধান চাষ করতে ১৫ কেজি বীজ, জমি চাষ, সার, কীটনাশক, লেবার, পানি সেচসহ মোট খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। এরপর সেই জমিতে খুব ভালো ধান হলে ৪৫ মণ ধান পাওয়া যায়। সেই ধান বিক্রি করলে ৪৫ হাজার টাকা দাম পাওয়া যায়; কিন্তু এই এক একর জমি যদি কৃষকের নিজের হয় তবে তাঁর পাঁচ-সাত হাজার টাকা লাভ হয়। আর যদি বর্গা জমি হয় তবে চাষির লোকসান গুনতে হয়।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সিরাজপুর ইউনিয়নের শাহজাদপুর গ্রামের কৃষক আবদুল হালিম জানান, বরিশাল, ভোলা, ও ফরিদপুর থেকে আসা ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকদের রেখে প্রতিদিন তিন বেলা খাবার খাইয়ে জনপ্রতি ৯০০ টাকা হারে মজুরি দিতে হচ্ছে।
বরগুনা সদরের খাজুরতলা এলাকার কৃষক ছগির মিয়া বলেন, ধান কাটতে একজন শ্রমিকের মজুরি দিতে হচ্ছে ৭০০ টাকা। জামালপুরে বর্তমানে স্থানভেদে সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকা শ্রমিক মজুরিতে ধান কাটাতে হচ্ছে কৃষকদের। এ ছাড়া ভোলায় কৃষি শ্রমিকের মজুরি দৈনিক ৮০০ টাকা, পটুয়াখালীর গলাচিপায় ৬০০ টাকা (সঙ্গে সকালে ও দুপুরের খাবার)।
কৃষিতে শ্রমিক সংকট উত্তরণে করণীয় বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘অবশ্যই কৃষির যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। জমি চাষ, সেচ, ধান মাড়াইয়ে যতটা যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে; ধান কাটা, শুকানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠেনি।’
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]