হাদীসের গল্প- খিজির (আ.)-এর সঙ্গী মূসা (আ.)

হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-র বরাতে এই হাদিসটির বর্ণনা আছে। তিনি নবী (সা.)-এর কাছে নিচের ঘটনাটি শুনেছেন।
একবার মূসা (আ.) বনি ইসরাইলের এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী? তিনি বললেন, আমি। মূসা (আ.)-এর এ উত্তরে আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন। কেননা তিনি জ্ঞানের উৎস হিসেবে আল্লাহর কথা বলেননি।
আল্লাহ মূসা (আ.)-কে বললেন, দুই নদীর সংযোগস্থলে আমার এক বান্দা আছে। সে তোমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। মূসা (আ.) আরজ করলেন, হে আমার রব! তাঁর কাছে পৌঁছাতে কে আমাকে সাহায্য করবে?
আল্লাহ বললেন, তুমি একটি মাছ ধরে থলের মধ্যে রাখো। যেখানে গিয়ে তুমি মাছটা হারিয়ে ফেলবে, সেখানেই তিনি আছেন। মূসা (আ.) একটি মাছ ধরে থলের মধ্যে ভরে রাখলেন। এরপর তিনি ও তাঁর সঙ্গী ইউশা ইবনে নুন যেতে যেতে একটি পাথরের কাছে পৌঁছে সেখানে মাথা রেখে বিশ্রামে বসলেন এবং মূসা (আ.) ঘুমিয়ে পড়লেন।
মাছটি নড়াচড়া করতে করতে থলে থেকে বেরিয়ে নদীতে নেমে গেল। আল্লাহ্ মাছটির চলার পথে পানির গতি স্তব্ধ করে দিলেন। মাছটির চলার পথ সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গেল। নবী‎ (সা.) হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, এভাবে সুড়ঙ্গের মতো হয়েছিল।
এরপর মূসা ও ইউশা ইবনে নুন বাকি রাত ও সমস্ত দিন পথ পেরিয়ে গেলেন। পরদিন ভোরে মূসা (আ.) তাঁর যুবক সঙ্গীকে বললেন, আমার সকালের নাশতা নিয়ে এসো। সফরের কারণে আমি খুব ক্লান্ত। আসলে মূসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশিত স্থানটি অতিক্রম না করা পর্যন্ত সফরে কোনো ক্লান্তি অনুভব করেননি। সঙ্গীটি বললেন, আপনি কি লক্ষ করেছেন, আমরা যখন সেই পাথরের কাছে বিশ্রাম নিয়েছিলাম, মাছটি চলে যাওয়ার কথা বলতে আমি একেবারেই ভুলে গেছি। আসলে আপনার কাছে সেটা বলতে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। মাছটি নদীতে আশ্চর্যভাবে নিজের পথ করে নিয়েছে। (রাবী বলেন) পথটি মাছের জন্য ছিল সুড়ঙ্গের মতো, আর তাঁদের জন্য সেটা ছিল অবাক ঘটনা।
মূসা (আ.) বললেন, এই সেই জায়গা, যা আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি।
এরপর দুজনই নিজ নিজ পদচিহ্ন ধরে পেছনের দিকে ফিরে চললেন, যে পর্যন্ত না তাঁরা সেই পাথরের কাছে এসে পৌঁছালেন। তাঁরা দেখলেন, সেখানে একজন লোক বসে আছেন।
মূসা (আ.) তাঁকে সালাম করলেন। সালামের জবাব দিয়ে তিনি বললেন, এখানে সালাম এলো কী করে? তিনি বললেন, আমি মূসা। লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি বনি ইসরাইলের মূসা? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনাকে শেখানো সহজ ও সঠিক জ্ঞানের কথা শেখার জন্য আমি আপনার কাছে এসেছি। তিনি বললেন, হে মূসা, আল্লাহর দেওয়া ও শেখানো কিছু জ্ঞান আমার আছে, আপনি তা জানেন। আল্লাহর দেওয়া ও শেখানো কিছু জ্ঞান আপনারও আছে, আমি তা জানি না।
মূসা (আ.) বললেন, আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি? খিজির (আ.) বললেন, আমার সঙ্গে থাকলে আপনি ধৈর্য রাখতে পারবেন না। তাছাড়া যার রহস্য আপনার জানা নেই, সেসব ব্যাপারে আপনি ধৈর্য রাখবেন কী করে?
মূসা (আ.) বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে দেখতে পাবেন। আমি আপনার কোনো আদেশই অমান্য করব না।
এরপর তাঁরা দুজনে রওনা হয়ে নদীতীর দিয়ে এগিয়ে চললেন। এমন সময় একটি নৌকা তাঁদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁরা তাঁদেরও নৌকায় উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলেন। ওরা খিজির (আ.)-কে চিনে ফেললেন, সঙ্গীসহ তাঁকে পারিশ্রমিক ছাড়াই নৌকায় তুলে নিলেন। তাঁরা নৌকায় ওঠার পর একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকার একটি পাশে বসল। পাখিটি দুয়েকবার পানিতে ঠোঁট ডোবাল।
খিজির (আ.) বললেন, হে মূসা, এই পাখিটি তার ঠোঁট দিয়ে নদীর পানি যতটুকু কমিয়েছে, আমার আর তোমার জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞান থেকে ততটুকুও কমেনি। এরপর খিজির (আ.) হঠাৎ একটি কুঠার নিয়ে এসে নৌকার একটি তক্তা উপড়ে ফেললেন। মূসা (আ.) হঠাৎ দেখতে পেলেন তিনি কুঠার দিয়ে একটি তক্তা উপড়ে ফেলেছেন। তিনি তাঁকে বললেন, আপনি এ কী করলেন? লোকেরা আমাদের মজুরি ছাড়াই নৌকায় তুলে নিল, আর আপনি ওদের নৌকার যাত্রীদের ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য নৌকাটি ফুটো করে দিলেন? এ তো আপনি এক গুরুতর কাজ করলেন।
খিজির (আ.) বললেন, আমি কি বলিনি, আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্য রাখতে পারবেন না?
মূসা (আ.) বললেন, আমি বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলাম। এজন্য আমাকে দোষ দেবেন না। আমার প্রতি কঠোরও হবেন না। মূসা (আ.)-এর পক্ষ থেকে প্রথম এই কথাটি ছিল ভুলক্রমে।
এরপর যখন তাঁরা দুজন নদী পার হয়ে এলেন। তাঁরা অন্য বালকদের সঙ্গে ক্রীড়ারত একটি বালকের পাশ দিয়ে গেলেন। খিজির (আ.) তার মাথাটি ধরে নিজ হাতে তার ঘাড় থেকে আলাদা করে ফেললেন।
মূসা (আ.) তাঁকে বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ বালককে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? নিশ্চয়ই আপনি একটা অন্যায় করলেন।
খিজির (আ.) বললেন, আমি কি আপনাকে বলিনি, আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্য ধরে রাখতে পারবেন না? মূসা (আ.) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করি, আপনি আমাকে আর আপনার সঙ্গে রাইখেন না। কারণ আপনার ওজর-আপত্তি চূড়ান্ত হয়েছে।
আবার তাঁরা চলতে লাগলেন। অবশেষে তাঁরা একটি জনপদে এসে পৌঁছালেন। গ্রামবাসীর কাছে তাঁরা খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাঁদের আতিথ্য দিতে অস্বীকৃতি করল।
সেখানে তাঁরা একদিকে ঝুঁকে পড়া একটা দেয়াল দেখতে পেলেন। সেটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। খিজির (আ.) সেটি নিজের হাতে সোজা করে দিলেন।
মূসা (আ.) বললেন, মানুষগুলো এমন যে আমরা এলাম, অথচ তারা আমাদের না দিল খাবার, না দিল আতিথ্য। অথচ আপনি ওদের দেয়াল সারিয়ে দিলেন। আপনি ইচ্ছা করলে এর বদলে মজুরি নিতে পারতেন।
খিজির (আ.) বললেন, এখানেই আপনার আর আমার মধ্যে বিচ্ছেদ হলো। তবে যে ঘটনাগুলোয় আপনি নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারেননি, সেসবের রহস্য আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি।
নবী‎ (সা.) বলেছেন, আমাদের তো ইচ্ছা যে মূসা (আ.) ধৈর্য ধরলে আমাদের কাছে তাঁদের আরও অনেক বেশি খবর বর্ণনা করা হতো। সুফিয়ান (র.) বর্ণনা করেছেন যে নবী‎ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ মূসা (আ.)-এর ওপর রহমত বর্ষণ করুন। তিনি যদি ধৈর্য ধরতেন, তাহলে তাদের দুজনার ব্যাপারে আমরা আরও অনেক ঘটনা জানতে পারতাম।
রাবী বলেন, ইবনে আব্বাস (রা.) এখানে পড়েছেন, তাদের সামনে একজন বাদশাহ ছিল। সে প্রতিটি নিখুঁত নৌকা জোর করে ছিনিয়ে নিত। সেই ছেলেটি ছিল কাফের। তার মা-বাবা ছিলেন মুমিন। সুফিয়ান (র.) আমাকে বলেছেন, আমি এ হাদিসটি তাঁর (আমর ইবনে দিনার) কাছ থেকে দুবার শুনেছি, তাঁর কাছ থেকেই মুখস্থ করেছি।
সুফিয়ান (র.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কি আমর ইবনে দিনার (র.) কাছ থেকে শোনার আগেই তা মুখস্থ করেছেন, নাকি অন্য কারো কাছ থেকে শুনে তা মুখস্থ করেছেন? তিনি বললেন, আমি কার কাছ থেকে এটা মুখস্থ করতে পারি? আমি ছাড়া আর কেউ কি এ হাদিস আমরের কাছে থেকে বর্ণনা করেছে? আমি তাঁর কাছ থেকে দু-তিনবার শুনেছি। তাঁর থেকে শুনেই এটা মুখস্থ করেছি।
আলী ইবনে খুররম (র.) সুফিয়ান (র.)-এর সূত্রে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসটির বিবরণ দিয়েছেন। সহীহ বুখারী, হাদিস : ৩৪০১।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।