ফড়িয়াদের কবজায় ধান, বিপাকে মিলাররা

বোরো ধান কাটা শুরুর পরপরই সক্রিয় ফড়িয়া বা দালালরা। সরকারি মূল্যের চেয়ে বেশি দিয়ে কৃষকের খলা থেকে ধান কিনে মজুতদারকে দিচ্ছেন তাঁরা। এতে কৃষকের কষ্টের ফসল গোলার পরিবর্তে উঠছে গুদামে। আমনের মতো বোরো মৌসুমেও সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে, কুষ্টিয়ায় আমন মৌসুমে চাল না দেওয়ায় বোরো চুক্তি থেকে দুই শতাধিক মিলারকে বাদ দিয়েছে সরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় বোরো ধান কাটার আগেই ফড়িয়া নিয়োগ করে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ফড়িয়ারা হাটবাজার ও কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনছেন। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিগুলো বেশি দামে কেনায় মিলাররা ধান কিনতে বিপাকে পড়েছেন। এতে চুক্তি করেও তাঁরা সরকারি গুদামে ধান দেওয়া নিয়ে চিন্তায় আছেন। বগুড়ার দুপচাঁচিয়া এলাকার মিলার মাহাবুব আলম বলেন, ‘সরকারকে ধান-চাল দিতে চুক্তি করেছি। কিন্তু বাজারে ধান পাচ্ছি না। বিভিন্ন কোম্পানি ফড়িয়াকে হাত করে বেশি দামে কিনে নিচ্ছে। তাদের তো সমস্যা হবে না। কারণ মোটা ধান কিনে মিনিকেট চাল করে প্যাকেটে তুলে বাজারে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করবে।’

জেলার নন্দীগ্রামের হাটবাজার ও কৃষকের খলা থেকে ধান কিনে একটি বহুজাতিক কোম্পানিকে দিচ্ছেন বুড়ইল ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার শংকর চন্দ্র সরকার। তিনি বোরো মৌসুম শুরুর প্রথম থেকেই ধান কিনছেন। শংকর চন্দ্র বলেন, ‘আমাদের কারণে কৃষকরা ধানের দাম একটু বেশি পাচ্ছেন। এতে আমরাও লাভবান হচ্ছি।’

জেলার মহাস্থান এলাকার ফড়িয়া আজিজুল হক ধান কিনে দিচ্ছেন আরেকটি বহুজাতিক কোম্পানিকে। তিনি বলেন, ‘তিন বছর আমি সরাসরি কৃষক থেকে ধান কিনছি। এর পর দেশের বড় বড় কোম্পানির কাছে বিক্রি করি। এতে ভালো লাভ থাকছে।’ বগুড়া সদরের লাহিড়িপাড়ার কৃষক সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘ধারদেনা করে ধানের আবাদ করি। ফড়িয়ারা খলা থেকে কিনে নিচ্ছেন। মিলে দিতে গেলে নানা ঝক্কি পোহাতে হয়। এত যত্নের ধান গোলায় তুলতে না পেরে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ঋণ তো শোধ দিতে হবে।’

সরকার বোরো মৌসুমে ৩০ টাকা কেজি ধান ও ৪৪ টাকা কেজি চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছে। জেলা খাদ্য বিভাগ জানায়, জেলায় ১৪ হাজার ১২৮ টন ধান ও ৫৭ হাজার ৬৩৯ টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সোমবার থেকে শুরু হওয়া অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু এবারও জেলায় ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন জানান, কয়েক বছর ধরেই ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না শস্যভান্ডারখ্যাত বগুড়ায়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বেশি দামে বাজার থেকে ধান কিনছে। তাদের সঙ্গে সক্রিয় স্থানীয় মজুতদাররাও। অভিযান চালিয়েও তাদের দমানো যাচ্ছে না। ফলে মিলাররা কিনতে না পেরে সরকারি গুদামে ধান-চাল দিচ্ছেন না।’

এদিকে, কুষ্টিয়ায় আমন মৌসুমে চুক্তি করে সরকারি গুদামে চাল দিতে না পারায় দুই শতাধিক মিলারকে বোরো সংগ্রহের চুক্তি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে মাত্র ১৮৫ মিলার চাল সরবরাহের সুযোগ পাচ্ছেন।
জেলা খাদ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলায় তালিকাভুক্ত মিলার চার শতাধিক। তাদের মধ্যে সদরের বৃহৎ মোকাম খাজানগর এলাকার মিলারই বেশি। এবার জেলায় ১৩৮টি হাসকিং মিল মালিক ও ৪৭টি অটোমিলের মালিক চুক্তির আওতায় এসেছেন। সরকার জেলায় ৩৮ হাজার ৪৮২ টন চাল ও ৩ হাজার ৯৮ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (কারিগরি) আবদুল খালেক বলেন, ‘আমন মৌসুমে চাল না দেওয়ায় মিল মালিকদের শাস্তি হিসেবে চুক্তির বাইরে রাখা হয়েছে। ১৮৫ মিলারের মাধ্যমে চাল সংগ্রহ করা হবে।’ তবে মিলার লিয়াকত হোসেন জানান, অতীতে লোকসান দিয়েও হাসকিং মিলাররা চাল সরবরাহ করেছেন। বর্তমানে তাঁরা দেনার দায়ে জর্জরিত। সরকার ক্ষমা করে সরবরাহের সুযোগ না দিলে আরও বিপদে পড়তে হবে।

চালকল মালিক সমিতির একাংশের সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, ‘উচ্চমূল্যের কারণে গত বোরোর পর আমন মৌসুমে চাল দিতে পারেননি মিলাররা। এটিকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। আশা করছি, সরকার বাদ পড়াদের কিছু হলেও বরাদ্দ দেবে।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।