উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’। বিপদ সামনে রেখে সারাদেশে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে সরিয়ে নিতে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত থাকলেও অরক্ষিত রয়েছে বেড়িবাঁধ। এতে ক্ষতি হতে পারে সম্পদের। চট্টগ্রাম ও খুলনা উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলে পানি ঢুকে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতেই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।
দেড় বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ঘোড়ামারা সাগর উপকূলের বেড়িবাঁধের কিছু অংশে মাটি ভরাট করলেও তা জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। ৪০০ মিটার বেড়িবাঁধ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার করেছে দেড়শ মিটার।
চট্টগ্রামে ২০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে বাঁশখালী উপজেলার উপকূলে।
এখানে ৩৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২২ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া সন্দ্বীপ উপজেলার ৫৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৮ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। সীতাকুণ্ডে ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে চার কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিতে আছে। আনোয়ারার ১৩ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার বাঁধ অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে বাঁশখালীর আট ইউনিয়নের উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তাণ্ডবে উপজেলার ছনুয়া, গণ্ডামারা, শিলকূপ, সরল, বাহারছাড়া, খানখানাবাদ, সাধানপুর ও পুকুরিয়ার বেড়িবাঁধ ভেঙে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এসব বেধিবাঁধ মেরামত না করায় এবারও আতঙ্কে আছেন হাজার হাজার মানুষ। এ ছাড়া সীতাকুণ্ডের সলিমপুর থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত উপকূলীয় বেড়িবাঁধের মধ্যে ঘোড়ামরা থেকে কুমিরা পর্যন্ত চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নেই বললেই চলে।
চট্টগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদুজ্জামান খান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাস কিংবা জোয়ার নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সতর্ক রয়েছে। জিও ব্যাগ ও সিনথেটিক ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলার ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ব্লক দিয়ে টেকসই করে ৯ মিটার উঁচু করে বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব বেড়িবাঁধ ব্লক দিয়ে টেকসই করে তৈরি করা হচ্ছে।
খুলনার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া গ্রামের উত্তর পাশের বাঁধের প্রায় ২৫০ মিটার ভেঙে গিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আম্পানে। দুই বছর ধরে ওই বাঁধসহ আশপাশের প্রায় দুই হাজার মিটার বাঁধ মেরামত করা হয়। তবে ওই এলাকায় বাঁধে ফের ধস নেমেছে। সেখানকার তিনটি স্থানে এ মুহূর্তে ৩০০ মিটারের মতো বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
কয়রা ও পাইকগাছার বাসিন্দারা জানান, ঘূর্ণিঝড় যদি খুলনা উপকূলে আঘাত না হানে, তারপরও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদনদীতে পানির চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। আর পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার ভয় আছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনার ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান জানান, তাঁদের অধীনে ৩৭৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও ছয় কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
পাউবো খুলনার ডিভিশন-২-এর অধীনে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ৬৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ১০ কিলোমিটার।
পাউবো সাতক্ষীরার ডিভিশন-১-এর অধীনে ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সাতক্ষীরা ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ বলেন, তাঁর আওতাধীন এলাকায় ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই বাঁধ মেরামত করা হবে।
পাউবোর বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ জানান, জেলার ৩৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে শ্যামনগর ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় তা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে খুলনার কয়রা উপজেলায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, এ মুহূর্তে গাতিরঘেরি, ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়ি, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও সিংহেরচর এলাকার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে এসব স্থানের বাঁধ উপচে অথবা ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, গত ১ মে কয়রা উপজেলার দুটি পোল্ডারের বাঁধ সরেজমিন পরিদর্শন করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক স্থানে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়েছে। বাকি কাজও দ্রুত শুরু করা হবে। এ ছাড়া জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সরাঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
অরক্ষিত বেড়িবাঁধে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বছরের পর বছর ধরে বাস করছেন উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, জেলায় টেকসই বাঁধ রয়েছে ৩৩৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার এলাকা। আর অরক্ষিত রয়েছে রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও সদর উপজেলার অন্তত ১৩০ কিলোমিটার এলাকা।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাকে ঘিরে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধের ৫ ও ১৫ নম্বর পোল্ডারের ভাঙনকবলিত ৫২টি পয়েন্টের মধ্যে অন্তত ১১টি অংশ এখন ঝুঁকিপূর্ণ।
পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে কচা নদীর তীরবর্তী ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে যাওয়ায় নদী তীরবর্তী অর্ধ লাখ বাসিন্দা ঘূর্ণিঝড় মোকার আঘাতে আতঙ্কে আছেন।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনা জেলার ২২টি পোল্ডারে ৮০৫ কিলোমিটার বাঁধের ২৪টি পয়েন্টে অন্তত আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।