খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরার ৮৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইল ৫ জেলায় আমাদের ১ হাজার ৮৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এরমধ্যে উপকূলীয় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা তিন জেলায় মোট ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। যার ৮৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এরমধ্যে ২৫ কিলোমিটার অতিঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। অপরদিকে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। সম্ভাব্য বিপদ সামনে রেখে প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে প্রস্তুতিও চলছে। তবে খুলনা আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আগামী ১৪ মে উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করবে। এর প্রভাবে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে হালকা বৃষ্টি হতে পারে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলে ঘূর্ণিঝড় মোখা আছড়ে পড়ার শঙ্কা নেই।

তবে এর প্রভাবে উপকূলে বৃষ্টি ও বাতাস হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. শফি উদ্দীন বলেন, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইল ৫ জেলায় আমাদের ১ হাজার ৮৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এরমধ্যে উপকূলীয় খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা তিন জেলায় মোট ১ হাজার ৪৪২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। যার ৮৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এরমধ্যে ২৫ কিলোমিটার অতিঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। তিনি বলেন, অতি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতে কাজ চলছে। ঘূর্ণিঝড় যদি আঘাত হানে তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে ঝড়ের গতিপথ অনুযায়ী খুলনায় বড় ধরনের প্রভাব না পরার সম্ভাবনা রয়েছে। তবুও আমরা প্রস্তুত রয়েছি। আমি নিজেও দাকোপসহ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করেছি। কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে বলা হয়েছে।

খুলনা জেলার কয়রার নিতিশ সানা বলেন, ঝড় আসলেই শঙ্কা বাড়ে। এরআগে আইলা, আম্পান ও ইয়াসে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। মাছের ঘের, পুকুর ও ফসলের মাঠ লবণ পানিতে তলিয়েছে, ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা আসছে জানতে পেরে উপকূলের মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। বিভিন্ন স্থানে স্বেচ্ছাশ্রমে দূর্বল বাঁধ বালু ও মাটি দিয়ে উঁচু করছে।

উপকূলবাসী জানান, তিন দিকে নদীবেষ্টিত কয়রার মূল সমস্যা নদীভাঙন। যেকোনো দুর্যোগে নদীতে জোয়ারের চাপ বাড়লে কোথাও না কোথাও বাঁধ ভাঙে। ভাঙন রোধে স্থায়ী সমাধানের চেষ্টার পাশাপাশি যারা দুর্দশায় আছেন তাদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর বেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে এ এলাকায় অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। আবার জীবিকার অন্বেষণে এলাকা ছেড়ে শহর ও নিকটবর্তী জেলামুখী হচ্ছেন কেউ কেউ। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানায় সেবারও বাঁধ ভাঙে এবং সেটি মেরামতের জন্য কর্তৃপক্ষ সময় নেয় ২ বছর। এই পুরো সময়ে বসবাসের জায়গাগুলো পানির নিচে ডুবে ছিল এবং অনেক পরিবারের জন্য বাঁধই ছিল একমাত্র আশ্রয়। ২০১১ সালে বাঁধ মেরামত করা হলে তারা তাদের বাড়ির যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেখানে ফিরে যান এবং আবারো শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে বাধ্য হন। তারপর আঘাত হানে ইয়াস। গত ১০ বছরে তারা যতটুকু গড়েছিলেন ইয়াসে তার সবই আবার নোনাপানির নিচে তলিয়ে যায়। এভাবেই চলছে কয়রাবাসীর ভাঙা-গড়ার দুর্বিসহ জীবন।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এখনও ঘূর্ণিঝড় মোখার তেমন কোন প্রভাব খুলনায় পড়েনি। ওইভাবে নাও পড়তে পারে। তবে জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশের শঙ্কা রয়েছে। আমরা দু-দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছি। উপজেলার প্রায় ১০টি স্থানে বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ৪০ দিনের কর্মসূচি ও স্বেচ্ছাশ্রমে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। সংকেত পেলে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হবে।

পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম বলেন, আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। নিয়ন্ত্রণক্ষ খোলা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতের কাজ করা হয়েছে। আশা করছি তেমন কোন সমস্যা হবে না।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, পাউবো খুলনার ডিভিশন-২ এর অধীনে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে মোট ৬৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৭ কিলোমিটারের ১৮ পয়েন্ট। এরমধ্যে কয়রা উপজেলার দশালিয়া, শিকারীবাড়ি, নয়ানী, মঠবাড়ি, জোড়শিং আংটিহারা, গোয়ালখালী, দাকোপ উপজেলার খোনা, লক্ষিখোলা, আচাবুয়া, বটবুনিয়া বাজার, পাইকগাছা উপজেলার চৌমহনা, মাহমুদকাঠি, বাসাখালী, বয়েরঝাপা, পার বয়েরঝাঁপা এলাকার সাতটি পোল্ডারের ১৮টি পয়েন্টে ৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে অথবা ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, দুর্যোগকবলিত কয়রার বেড়িবাঁধের ভাঙন রোধে তারা স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছেন। কয়েক দিনের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প শুরু হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঝুঁকি কমবে। তিনি বলেন, আপাতত বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশের তালিকা করা হয়েছে। কিছু এলাকায় সংস্কারের কাজও শুরু হয়েছে। অন্য জায়গাগুলোতেও কাজ করা হবে।

খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সভা করা হয়েছে। জেলার ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষদের জন্য শুকনা খাবার, পানি, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণকক্ষ। এছাড়া নির্দেশনা অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষার মালামাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষি, প্রাণী ও মৎস্য বিভাগকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড প্রস্তুত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য বলা হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি দেখা হচ্ছে। দুর্যোগপূর্ব সার্বিক প্রস্তুতি আমরা গ্রহণ করেছি।

খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলেন, এখনও ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব পড়েনি খুলনায়। তবুও আমরা প্রস্তুত রয়েছি। মানুষকে সচেতন করছি। বিপদ সংকেত পেলে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় দুই হাজার ১৩৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় ১৬, সাতক্ষীরায় ২৬ এবং বাগেরহাটে ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য আঘাত বা পানির চাপে এই ৫২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত বা বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলে খুলনা উপকূলে পানি ঢোকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে রকম কিছু ঘটলে ফের এ জেলাগুলোতে সম্পদের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।

খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়া গ্রামের উত্তরপাশের বাঁধের প্রায় ২৫০ মিটার ভেঙে গিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আম্পানে। দুই বছর ধরে ওই বাঁধসহ আশপাশের প্রায় দুই হাজার মিটার বাঁধ মেরামত করা হয়। ওই এলাকায় বাঁধে ফের ধস নেমেছে। সেখানকার তিনটি স্থানে এ মুহূর্তে ৩০০ মিটারের মতো বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

কয়রা ও পাইকগাছার বাসিন্দারা জানান, ঘূর্ণিঝড় যদি খুলনা উপকূলে আঘাত না হানে, তারপরও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদ-নদীতে পানির চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। আর পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার ভয় আছে।

পাউবো খুলনার ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রহমান জানান, তার দায়িত্বের অধীনে ৩৭৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ছয় কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

পাউবো খুলনার ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জানান, তার অধীনে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে ৬৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ৭ কিলোমিটার।

সাতক্ষীরা ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ জানান, তার আওতাধীন এলাকায় ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই বাঁধ মেরামত করা হবে। অপরদিকে, পাউবো সাতক্ষীরা ডিভিশন-১-এর অধীনে ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে তিন কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

পাউবোর বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম বিল্লাহ জানান, জেলার ৩৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে শ্যামনগর ও মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় তা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।

বাগেরহাট শহরের বাসিন্দারা বলছেন, মোখার খবর শোনার পর তারা আতঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু সকালে থেকে আবহাওয়া স্বাভাবিক। প্রচণ্ড গরম হলেও সাধারণভাবেই তারা দিন পার করছেন।

শরণখোলা উপজেলার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাদের এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বলেশ্বর ও ভোলা নদী স্বাভাবিক রয়েছে। আবহাওয়াও ভালো। আকাশে কোন মেঘ নেই। তবে রাতে ঝড়ের আঘাতের শঙ্কায় রয়েছেন তারা।

সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির বলেছেন, সকাল থেকে সুন্দরবনের আবহাওয়া স্বাভাবিক। এখনও কোনো শঙ্কা সৃষ্টি হয়নি।

আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলেও মোখা মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাগেরহাট জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ৪৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সাথে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার, নগদ অর্থ ও প্রয়োজনীয় স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখা মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছেন।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।