সিডরের পর বেশি গতি মোখার, সবচেয়ে ঝুঁকিতে যেসব এলাকা

দুই দশকে বাংলাদেশে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ছিল সিডর। এটির পর বেশি শক্তি সঞ্চয় করে উপকূলের দিকে এগোচ্ছে ঘূর্ণিঝড় মোখা। পূর্বাভাস অনুযায়ী, রোববার অতিপ্রবল ঝড়টি বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এই ঝড়ের প্রভাবে এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলায় হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মধ্যরাতের মধ্যে সেখানে দমকা হাওয়া শুরু হতে। আর ঝড়ের দাপট দেখা দিতে পারে আগামীকাল ভোর ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডর ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার গতি নিয়ে উপকূলে আঘাত হেনেছিল। বাতাসের গতি তীব্র থাকায় ও জনবহুল এলাকায় আঘাত করায় ওই ঝড়ে মানুষের মৃত্যু পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর ২০০৯ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আইলায় বাতাসের গতিবেগ ১১০ থেকে ১১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ছিল। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১০ থেকে ১২ ফুট বেশি ছিল। যে কারণে তাতে দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত ক্ষতি বেশি হয়। ওই দুই ঝড়ই মূলত খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাট উপকূল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

সেখানে ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানতে পারে। তা হলে গত দেড় দশকের মধ্যে বাংলাদেশের এই অঞ্চলে প্রথম ঝড় হবে এটি। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়ার আকারে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, ঘূর্ণিঝড়টি আগামীকাল দুপুর নাগাদ কক্সবাজার ও মিয়ানমারের কিয়াউকপু উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৮০–১৯০ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়া আকারে ২১০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা থেকে বাঁচাতে সাগরের ট্রলারগুলোকে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার চেষ্টা চলছে এখন। একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের আগেও
অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা থেকে বাঁচাতে সাগরের ট্রলারগুলোকে নিরাপদ স্থানে নেওয়ার চেষ্টা চলছে এখন। একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের আগেওছবি: প্রথম আলো
আবহাওয়া অধিদপ্তর মোখার কারণে শুক্রবার কক্সবাজার ও এর আশপাশের দ্বীপ ও চরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত জারি করেছে। উপকূলবর্তী আরও ১১টি জেলা এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরে জারি করা হয়েছে ৮ নম্বর মহাবিপৎসংকেত। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৮ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। ১০টি জেলায় ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। পাঁচ জেলার পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের আশঙ্কাও আছে।

বাংলাদেশের দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট নিড অ্যাসেসমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের একটি প্রভাব বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯৩ কিলোমিটার বা তার বেশি গতিতে বাতাস বয়ে যেতে পারে ৪টি জেলার ২০টি উপজেলার ওপর দিয়ে। এতে ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ, যার মধ্যে প্রায় ২৮ লাখ নারী, ৭ লাখ ৫৮ হাজার শিশু (৪ বছরের কম বয়সী) ও ৭৪ হাজার ৬৭৩ জন প্রতিবন্ধী। নারীদের মধ্যে ৭৪ হাজারের বেশি সন্তানসম্ভবা। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় ৭ লাখ ৬৩ হাজারের কিছু বেশি কাঁচা ও ঝুপড়ি রয়েছে। এসব ঘর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মানুষকে নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। ১৩ মে, নোয়াখালীপাড়া, মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার।
মানুষকে নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। ১৩ মে, নোয়াখালীপাড়া, মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার।ছবি: সাজিদ হোসেন
বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা শতাধিক বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো যৌথভাবে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এর নেতৃত্ব দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সম্ভাব্য দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর তথ্য, বাতাসের সম্ভাব্য গতি, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বিবেচনা করে ঝুঁকি মানচিত্রসহ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে তারা।

গবাদিপশু ও মালামাল নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যাচ্ছেন মানুষেরা। ১৩ মে, কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার।
গবাদিপশু ও মালামাল নিয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যাচ্ছেন মানুষেরা। ১৩ মে, কুতুবদিয়াপাড়া, কক্সবাজার।ছবি : জুয়েল শীল
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন উপকূলের কাঁচা ও ঝুপড়িঘরের বাসিন্দারা। ওই এলাকা দেশের অন্যতম দারিদ্র্যপ্রধান। সেখানে বসবাস করা রোহিঙ্গা শিবিরের অধিবাসী, পার্বত্য জেলাগুলোর বাসিন্দা ও চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর বড় অংশের মানুষ দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা মাটি, টিন ও ঝুপড়িঘরে বাস করেন। ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় এ ধরনের ঘরের সংখ্যা ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৪৫৭।

কক্সবাজারের সবচেয়ে বেশি এলাকা উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও উখিয়া, চকরিয়া ও মহেশখালীতে ঝড়ের বাতাস ও বৃষ্টির কারণে ঝুঁকি বেশি। রাঙামাটির বিলাইছড়ি ও জুয়াছড়ি এবং বান্দরবানের আলীকদমও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পড়েছে। চট্টগ্রামের জেলাগুলোর মধ্যে চকরিয়াতে উচ্চ ঝুঁকি এবং বাঁশখালী, লোহাগড়া ও সাতকানিয়ায় মাঝারি মাত্রার ঝুঁকি রয়েছে। এসব জেলায় ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার গতিতে বাতাস বইতে পারে। ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে সেখানে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও আছে।

এসব এলাকার বাইরে উপকূলীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে সেন্ট মার্টিন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। সেখানে শতাধিক পর্যটন হোটেল ও মোটেল রয়েছে। তবে আজ দিনের মধ্যে এসব পর্যটনকেন্দ্রের কর্মীরা টেকনাফ ও কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে স্থানীয় প্রায় আট হাজার মানুষ দ্বীপটিতে রয়ে গেছেন। তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হোটেল–মোটেলগুলোয় আশ্রয় নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাব্য ঝুঁকির মুখে থাকা লোকজনের বড় অংশকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। সেন্ট মার্টিনে থাকা মানুষদের আপাতত সেখান থেকে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তাই তাঁদের হোটেল–মোটেলে নিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে সাত দিনের খাবার মজুত আছে।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।