স্টাফ রিপোর্টার : ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এখন বাংলাদেশী পর্যটকের ভিড় বেড়ে গেছে। অতীতের সব রেকর্ড পেছনে চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই ৪৮ হাজারেরও বেশি পর্যটক শ্রীনগরে গেছেন বলে খবরে প্রকাশ। কাশ্মীরের পর্যটন বিভাগ জানাচ্ছে, ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলো থেকে চলতি ২০২৩ সালে কাশ্মীর ভ্যালিতে পর্যটক এসেছেন হাজার সাতেক। ফলে একা বাংলাদেশ থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় প্রায় সাতগুণ বেশি পর্যটক এ বছরে কাশ্মীরে বেড়াতে গেছেন।
শ্রীনগরে পর্যটন বিভাগের কর্মকর্তারা এমনও বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে তাদের রাজ্যে বাংলাদেশি পর্যটকের সংখ্যা হয়তো একদিন দেশি (ভারতীয়) পর্যটকদেরও ছাপিয়ে যাবে। বাংলাদেশিদের মধ্যে কাশ্মিরের জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও দারুণ খুশি। এতদিন ভারতে হিমালয়ের দার্জিলিং বা সিকিম অঞ্চলেই বাংলাদেশি পর্যটকদের বেশি আনাগোনা ছিল। কাশ্মীরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয় বিধায় বিদেশিরা শ্রীনগর বা আশপাশের এলাকাগুলো এড়িয়েই চলতেন। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে।
দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আমরা পর্যটন ভিসার জন্য যেসব আবেদন পাচ্ছি তার একটা বড় অংশ, প্রায় পঁচিশ শতাংশের মতো কাশ্মিরে যেতে চাইছেন। গত বছর থেকেই বাংলাদেশে ভারতের ভিসা দেওয়ার হারও অনেক বেড়ে গেছে।
২০১৯ সালের আগস্ট মাসে কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পর সেখানে পরিস্থিতি অনেক শান্তিপূর্ণ হয়েছে এবং জঙ্গি তৎপরতা কমেছে বলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যে দাবি করে থাকেবিদেশি পর্যটকদের এই ঢল সেই বক্তব্যের সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ।
ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা আতিকুজ্জামান স্বপন গত এপ্রিল মাসের গোড়াতেই শ্রীনগর-গুলমার্গ-পহেলগাম-সোনমার্গ ঘুরে গেছেন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। দিল্লী থেকে দেশে ফেরার আগে তিনি বলছিলেন, ‘এটা আচমকা কিছু নয়। এই উপমহাদেশের প্রত্যেক মানুষেরই বোধহয় স্বপ্ন জীবনে একবার অন্তত ভূস্বর্গ কাশ্মীর ঘুরে আসা। তবে এতদিন আমাদের সেই সুযোগ ছিল না, পরিবেশে একটা আতঙ্কও ছিল। এখন সেসব অনেকটা কেটে গেছে বলেই গোটা ফ্যামিলি নিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ করে গেলাম।’
ঢাকার আরেক বাসিন্দা মিজানুর রহমান সোহেলও বন্ধুদের একটি গ্রুপ নিয়ে কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলেন মার্চ মাসে। ‘কাশ্মির ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যে কী অবিস্মরণীয় ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা তো ছেড়েই দিলাম, হোটেলের কর্মী থেকে হাউজ বোটের চালক, ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে ট্যুরিস্ট গাইড, সবাই যেভাবে আমাদের আপ্যায়ন করেছেন তা ভোলার নয়। মনে হচ্ছিল তারা যেন আমাদের অপেক্ষাতেই এতদিন বসে ছিলেন।’ কাশ্মিরে বেড়াতে আসা হাজার হাজার বাংলাদেশির কেউ মুগ্ধ হচ্ছেন স্থানীয়দের আতিথেয়তায়, কেউ বা ভ্যালির অনিন্দ্য সুন্দর নিসর্গে। প্রতি মাসেই উপত্যকায় ওই পর্যটকদের সংখ্যা যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এতে বোধহয় তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর: যে গল্পের শেষ নেই
ইতিহাস বলছে, ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা পাবার আগে থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান -যে কোন রাষ্ট্রেই যোগ দিতে পারবে।
এদিক থেকে কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সাথে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে।
১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতে যোগ দেবার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ-যা চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। এরই প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোট,পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়।
যার ফলে ওই বছরেই কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয়। তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মীর কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়।
অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যদিয়ে চীন কাশ্মীরের আকসাই-চিন অংশটির নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। আর এর পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনের হাতে ছেড়ে দেয়। সেই থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান,ভারত ও চীন-এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে।
দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে। এর পর আরেকটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় তাদের মধ্যে। এরপর ১৯৭১-এর তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭২-এর সিমলা চুক্তির মধ্যে দিয়ে বর্তমানের ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণ রেখা চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে-যা নিয়ন্ত্রণরেখা দিয়ে চিহ্নিত নয়।
তাছাড়া ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বাহিনী আরেকটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু তিক্ত লড়াইয়ে জড়ায় পাকিস্তান-সমর্থিত বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে। ১৯৯৯-এর সেই ‘কারগিল সংকটের’ আগেই দু’দেশ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়।
ভারত-শাসিত কাশ্মীরে এত সংঘাত-সহিংসতা কেন?
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের অনেকেই চায় না যে, এলাকাটি ভারতের শাসনে থাকুক। তারা চায়- হয় পূর্ণ স্বাধীনতা, অথবা পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তি।
কারণ ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশেরও বেশি মুসলিম। এটিই হচ্ছে ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এখানে বেকারত্বের হার অত্যন্ত বেশি, তাছাড়া রাস্তায় বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহীদের দমনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নীতি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে।
কাশ্মীরে বিদ্রোহী তৎপরতা বড় আকারে শুরু হয় ১৯৮৭ সালে বিতর্কিত স্থানীয় নির্বাচনের পর জেকেএলএফ নামে সংগঠনের উত্থানের মধ্যে দিয়ে। ভারত তখন অভিযোগ করে, পাকিস্তান সীমান্তের ওপার থেকে যোদ্ধাদের পাঠাচ্ছে-তবে পাকিস্তান তা অস্বীকার করে।
রাজ্যটিতে ১৯৮৯ সালের পর থেকে সহিংস বিদ্রোহ নানা উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে। তবে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ২২ বছর বয়স্ক জঙ্গী নেতা বুরহান ওয়ানি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এক লড়াইয়ে নিহত হবার পর থেকে পুরো উপত্যকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বুরহান ওয়ানি সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন এবং এতে তার প্রকাশ করা বিভিন্ন ভিডিও তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। মনে করা হয়, এ অঞ্চলে জঙ্গী তৎপরতা পুনরুজ্জীবিত করা এবং তাকে একটা ‘ন্যায় সঙ্গত ইমেজ’ দেয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
রাজধানী শ্রীনগরের ২৫ মাইল দূরের ট্রাল শহরে বুরহান ওয়ানির শেষকৃত্যে সমাগম হয়েছিল হাজার হাজার লোকের। জানাজার পর শুরু হয় সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষ, কয়েক দিনব্যাপী সহিংসতায় নিহত হয় ৩০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোক।
এরপর থেকেই রাজ্যটিতে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা চলেছে। ২০১৮ সালে বেসামরিক লোক, নিরাপত্তা বাহিনী এবং জঙ্গী মিলে মোট নিহত হয় ৫০০ জনেরও বেশি-যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
কাশ্মীর এখন বিভক্ত লাইন অব কন্ট্রোল (ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা) বরাবর। এ ছাড়াও আকসাই-চিন এবং সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরের আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে চীন। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বহু রক্তপাতের পর ২০০৩ সালে দু’দেশ একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল।
পাকিস্তান পরে কাশ্মীরের বিদ্রোহীদের অর্থায়ন বন্ধ করার অঙ্গীকার করে। আর ভারত প্রস্তাব করে-বিদ্রোহীরা জঙ্গী তৎপরতা বন্ধ করলে তাদের ক্ষমাও করে দেওয়া হবে।
এরপর ২০১৪ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর তারা পাকিস্তানের ব্যাপারে কঠোর নীতি নেবার অঙ্গীকার করে। তবে শান্তি আলোচনার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখায় তারা। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন অতিথি হিসেবে।
কিন্ত এর এক বছর পরই পাঞ্জাবের পাঠানকোটে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ হয়- যার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করে ভারত। ওই সময় মোদি ইসলামাবাদে তার নির্ধারিত সফর বাতিল করে দেন। এর পর থেকে দু’দেশের মধ্যে আলোচনায় আর কোন অগ্রগতি হয় নি। (সূত্র-বিবিসি)