জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালায়’ পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে ভোটকেন্দ্র কোন প্রতিষ্ঠানে হবে তা নির্ধারণের ক্ষমতা রাজনীতিক, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আগের নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র বহাল রাখার বাধ্যবাধকতাও তুলে দিচ্ছে। এসব বিধান যুক্ত করে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’র খসড়া অনুমোদন দিয়েছে ইসির একটি কমিটি। নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে ‘ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি’ কমিটি গতকাল মুলতবি সভায় এ অনুমোদন দেয়। ওই খসড়া নীতিমালা এখন কমিশনে তুলবে ইসি সচিবালয়। কমিশন অনুমোদন দিলেই তা কার্যকর হবে। ইসির নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই নির্বাচন সামনে রেখে এ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এ নীতিমালা কার্যকর হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে নতুন স্থানে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ তৈরি হতে যাচ্ছে। একইভাবে আগের অনেক কেন্দ্র বাতিল হয়ে যাবে। পাশাপাশি ভোটকেন্দ্র স্থাপনে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের এতদিন একচ্ছত্র যে ক্ষমতা ছিল তা হারাতে বসেছেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করেও নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা নিয়ে কমিটির বৈঠক হয়েছে। এতে সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য পৃথক ভোটকেন্দ্র নীতিমালা একত্রিত করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আরেকটি নীতিমালা করছে। তিনি বলেন, কমিশন অনুমোদন দেওয়ার আগে নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা, পরিবর্তন এলেও কী ধরনের হতে পারে তা বলা যায় না। কারণ এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা কমিশনের বিষয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ের তিনজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও) এর ৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের ক্ষমতা ইসির। কমিশনের পক্ষে নির্বাচন কর্মকর্তারা ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করেন। জাতীয় নির্বাচনে যেহেতু জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকেন, তাদের মতামত নিয়েই নির্বাচন কর্মকর্তারা তালিকা ইসিতে পাঠিয়ে থাকেন। নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে ইসির কর্মকর্তাদের ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের ক্ষমতা অনেক কমে যাবে। ওই ক্ষমতা যাবে স্থানীয় প্রশাসনের হাতে।
যেভাবে নির্ধারিত হবে ভোটকেন্দ্র : জানা গেছে, বিগত নির্বাচনগুলোতে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারা ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের কাজ করে আসছেন। এবার সেখানে নতুন নিয়ম সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশকৃত নীতিমালায় ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ কার্যক্রমকে মহানগর বা জেলা ও উপজেলা-মোটা দাগে এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মহানগর ও জেলা পর্যায়ের ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি থাকবে। কমিটির সদস্যরা হলেন-বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি, পুলিশ সুপার (এসপি), সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধি, জেলা শিক্ষা অফিসার ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার। এ কমিটিতে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। আর উপজেলা পর্যায়ের ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ কমিটির প্রধান হবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। কমিটির সদস্যরা হলেন-উপজেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও অফিসার ইনচার্জ (ওসি)। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এ কমিটির সদস্য সচিব হবেন।
ভোটকেন্দ্র বাছাই প্রক্রিয়া সম্পর্কে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে-উপজেলা বা থানা নির্বাচন কর্মকর্তা খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকা উপজেলা কমিটির কাছে উপস্থাপন করবেন। কমিটির সবার মতামতের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্রের খসড়া চূড়ান্ত করবেন। ওই খসড়া জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। এরপর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ওই তালিকা জেলা ও মহানগর কমিটি সভায় উপস্থাপন করবেন। কমিটির সদস্যরা একই প্রক্রিয়ায় তাদের মতামত জানাবেন। প্রয়োজনে সরেজমিন যাবেন। এভাবে ভোটকেন্দ্রের তালিকা তৈরি করতে হবে।
ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করার যৌক্তিকতা হিসাবে বলা হয়েছে, শিক্ষা অফিসাররা তার আওতাধীন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত অবস্থান ও যাতায়াত সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত থাকেন। আর পুলিশ কর্মকর্তা ওইসব কেন্দ্রের যাতায়াত ব্যবস্থা ও সার্বিক নিরাপত্তা সম্পর্কে অবগত থাকেন। আর জেলা প্রশাসক ও ইউএনও সংশ্লিষ্ট এলাকার সরকারি ও নির্বাচন কমিশনের নানাবিধ কার্যক্রমের মুখ্য সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করেন। তাই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অফিসারদের সমন্বয়ে কমিটির মাধ্যমে ভোটকেন্দ্র স্থাপন কার্যক্রম অধিকতর সহজ ও সুষ্ঠু হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়।
গত নির্বাচনের কেন্দ্র পরিবর্তন করা যাবে : আরও জানা গেছে, ইসির বিদ্যমান নীতিমালায় নদীভাঙন বা অন্য কোনো কারণে বিলুপ্ত না হলে আগের ভোটকেন্দ্র বহাল রাখার বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালায় ওই বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে অবকাঠামোগত সুবিধা থাকলে ভোটকেন্দ্র পরিবর্তন করার জন্য বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করার কথা বলা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক নেতারা বলতে কোন দলের নেতা হবেন তা নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়নি।
আগের ভোটকেন্দ্র পরিবর্তনের যৌক্তিকতা হিসাবে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ইতোমধ্যে অনেক নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এছাড়া পুরোনো অনেক স্থাপনা সংস্কার করে কিংবা নিকটবর্তী নতুন স্থানে নতুন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। ভোটকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে ভোট দেওয়ার সুবিধা বিবেচনা করে নতুন স্থাপনা কেন্দ্রের জন্য নির্ধারণ করা যাবে। তবে বিগত নির্বাচনে যেসব কেন্দ্রে গোলযোগ হয়েছে বা বর্তমানে কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রভাবাধীন থাকার সম্ভাবনা রয়েছে সেসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার জন্য নীতিমালায় বলা হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, প্রতিটি নতুন ভোটকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য নীতিমালায় বলা হয়েছে। তবে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানে যতদূর সম্ভব ভোটকেন্দ্র স্থাপন না করার জন্য নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্র স্থাপনে যাতায়াত ব্যবস্থা ও ওই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা চৌহদ্দি আছে কিনা-সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।