চার মেয়াদে সরকার গঠন করে ইন্দিরা গান্ধী বা মার্গারেট থ্যাচারকেও ছাড়িয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে এশিয়ার লৌহমানবী অভিহিত করেছে দ্য ইকোনমিস্ট।
ব্রিটিশ এই সাময়িকীর বিশ্লেষণে ১৭ কোটির মানুষের জনবহুল বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য দারিদ্র্য বিমোচনে নেতৃত্ব দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে বেশিরভাগ সময় জিডিপির বার্ষিক গড় হার ছিল সাত শতাংশ। সমকালীন বৈশ্বিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এটি অভাবনীয় বলে অভিহিত করেছে ইকোনমিস্ট।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটন সফরের সময় তার সাক্ষাৎকার নেয় দ্য ইকোনমিস্ট। বুধবার ‘এশিয়ার লৌহ মানবী শেখ হাসিনা’ শিরোনামে সেই সাক্ষাৎকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিশ্লেষণটি প্রকাশ করা হয়।
সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত দেশ করতে চাই।
’৭৫ এর অগাস্টে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিষয় তুলে ধরে তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা সাংবাদিককে বলেন, আপনি কি ভাবতে পারেন তারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে? তারা আমার ভাইকে, আমার মাকে, আরেক ভাইকে হত্যা করেছে—মাত্র দশ বছর বয়সী ভাই! আমার দুই ননদ, আমার একমাত্র চাচা, সবাইকে হত্যা করেছে,’—অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এই ঘটনার ছাপ তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ছাপ রেখেছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো রাজনীতিবিদই সমালোচনা পছন্দ করেন না। দুর্নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হওয়া সামরিক সরকারকে দায়ী করেন।
একই সঙ্গে তার সরকারের সদস্যদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে একটি প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার ঘটনায় বিশ্বব্যাংককে অভিযুক্ত করেন। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে অভিযোগ তুলেছিল, সেটির কোনো অস্তিত্ব নেই বলেও দাবি করেন তিনি। বলেন, ‘থাকলেও হয়তো নিচের স্তরে, কিন্তু আজকাল তেমনটা ঘটছে না। কেউ যদি এমন কিছু করার দুঃসাহস দেখায় তবে আমি ব্যবস্থা নেব!’
প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবানদের শাসনে থাকা আফগানিস্তানের পর বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় রাখা হয়েছে। ২০০৮ সালে তিনি পুনঃনির্বাচিত হওয়ার আগে খালেদা জিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে বারবার ক্ষমতা পরিবর্তিত হয়েছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে মিডিয়া, পুলিশ এবং আদালতসহ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো সেসময় কিছুটা স্বাধীন ছিল। বর্তমানে বেগম জিয়া গৃহবন্দী, তার দলের কর্মী-সমর্থক মারধরে শিকার, মিডিয়া ভীত এবং পুলিশ ও আদালত শেখ হাসিনার দলের অধীন। কাকতালীয়ভাবে নয়, তারা দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দুটি দল।
আগামী নির্বাচন বিএনপিকে ফেরার পথ দেখাবে না। যদিও শেখ হাসিনা একটি স্বাধীন ভোটের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে দাবি করেন, তিনি বলেছেন, শুধু একটি ‘প্রকৃত রাজনৈতিক দল’ কেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়া উচিত এবং বিরোধী দল কোনো মানদণ্ডের সঙ্গেই মানানসই নয়।
তিনি অর্ধশতাব্দী আগে সেনা শাসনের অধীনে গঠিত বিএনপিকে ‘একজন সামরিক শাসক কর্তৃক অবৈধভাবে গঠিত’ বলে অভিযোগ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল পাকিস্তানের সাবেক মিত্র, তাদের ‘প্রায় সবাই যুদ্ধাপরাধী’। আমাদের বক্তব্য হলো যে এমন কোনো দল নেই (আওয়ামী লীগ ছাড়া) যারা সত্যিই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।’
প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার টানা ক্ষমতায় থাকার সুফল তুলে ধরে বলা হয়, এর ফলে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। অনেক খাতের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। যেমন দেশের পোশাক শিল্প এবং অভিজাত এনজিওদের সরবরাহিত পরিষেবাগুলোর মান বেড়েছে। তবুও তিনি অবকাঠামো বিনিয়োগসহ নীতিগুলি তৈরি করেছেন, যা প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সাহায্য করেছে। কোনো দুর্বল সরকার হলে এসব সম্ভব হতো না।
ইকোনোমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়, কিন্তু শুধু একই খাত থেকে আয় হ্রাস পেয়েছে। পোশাকের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল বাংলাদেশকে নতুন রপ্তানিতে বিকাশ ঘটাতে হবে। এটি এখন দেশটির বাস্তবতা এবং সরকার খুব কমই তা মোকাবিলা করছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হস্তশিল্প এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বিকাশের দিকে নজর দিচ্ছেন। কিন্তু এটি একটি অপর্যাপ্ত সমাধান বলে মনে করছে ইকোনমিস্ট।
বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমেরিকা হয়তো একসময় শেখ হাসিনাকে সতর্ক করেছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিতে। এখন দেশটি প্রধানত উদ্বিগ্ন চীন তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে, যেটি উচিত নয় বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারত, যার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে তাদেরও একই দৃষ্টিভঙ্গি। শেখ হাসিনাকে তিনটি শক্তিকেই ঢেলে সাজানোতে পারদর্শী বলে মনে হয়। সরকারপ্রধান এ বিষয়ে বলেন, ‘আমেরিকা ও চীনের সম্পর্ক তাদের নিজস্ব বিষয়। আমি সেখানে নাক গলাব কেন?’ তারপরও তিনি আমেরিকার দিকে খোঁচা দিয়ে কথা বলেন। কারণ এটি একসময় বেগম জিয়ার কাছাকাছি ছিল। ‘তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবি করে…কিন্তু আমাদের দেশে তারা তা প্রয়োগ করে না। কেন তারা আমাকে সমর্থন করে না?’
ইকোনমিস্ট বলেছে, শেখ হাসিনার দীর্ঘ কর্মজীবন সাহসিকতার। কিছু নীতিগত সাফল্য যা তিনি দাবি করতে পারেন এবং মহাকাব্যের মতো কোনো জাতীয় উন্নয়ন হয়তো তিনি ঘটাতে পারবেন না রাতারাতি, কিন্তু তিনি চেষ্টা করছেন। তার এই গল্পটি কীভাবে শেষ হবে তা দেখা কঠিন। তিনি নিশ্চিত করেছেন, অবসর নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই।
তার সরকারের সর্বশেষ পরিকল্পনার হলো ভিশন-২০৪১৷ তিনি এটি হয়তো দেখে যেতে পারবেন না বলে ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি যখন ক্ষমতায় তৃতীয় দশক পেরিয়েছেন, তখনও উত্তরাধিকার পরিকল্পনা তার এজেন্ডায় নেই। তিনি বলেন, ‘কারণ আমি যদি না থাকি… আমি জানি না কে ক্ষমতায় আসবে।’