কয়লা সংকটে রবিবার দিনগত মধ্যরাত থেকে পুরোপুরি বন্ধ হতে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম ও সর্বাধুনিক পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হলে জাতীয় গ্রিডে অন্তত ১২শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এতে দেশে ভয়াবহ লোডশেডিং দেখা দিতে পারে।
বিদ্যুৎ ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এ সংকট আরও কিছু দিন থাকবে।’
পায়রা বন্ধ হওয়ার বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি হাফ বন্ধ আছে এবং আমাদের সেকেন্ড হাফও আগামী ৫ জুনের পর বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, এখানে কয়লার অভাব দেখা গেছে এবং এটা আসতে ২০-২৫ দিন লেগে যাবে।’
টানা তিন বছর ধরে চলমান পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সংকটের কারণে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণারূপে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাকিতে কয়লা এনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল রাখা হয়েছিল। এর আগে কয়লা সংকটে ২৫ মে এর একটি ইউনিট বন্ধ হয়েছিল। কয়লার মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় অবশিষ্ট ইউনিটও বন্ধ হতে যাচ্ছে। মূলত ডলার সংকটে বিদেশ থেকে কয়লা আনা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দেনা প্রায় ৩৬ কোটি ডলার। এই বকেয়া পরিশোধ না করলে নতুন করে কয়লা আনা সম্ভব হবে না।
পায়রা-১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিদিন অন্তত ১৩ হাজার টন কয়লা পোড়াতে হয়। যা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করত কর্তৃপক্ষ। ডলার সংকটে এতদিন বাকিতে কয়লা এনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালানো হচ্ছিল। কিন্তু বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় মূল্য পরিশোধ না করলে আর কয়লা দেওয়া হবে না আরও আগেই জানিয়েছিল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। কয়লা না পাওয়ায় এর আগে একটি ইউনিট বন্ধ হয়। কয়লা কাটাতে সংশ্লিষ্টরা কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। কিন্তু তাকে কোনো সমাধান মেলেনি। ফলে দ্বিতীয় ইউনিটটিও আজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান সিএমসির মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনা হতো। পরে দুই প্রতিষ্ঠানের সমান মালিকানায় বাংলাদেশ-চীন পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) নামে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। বিগত দিনে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ৬ মাস বাকিতে কয়লা দিয়েছে সিএমসি। পরে আরও ৩ মাসের বকেয়াসহ ৯ মাসে বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ৩৯ কোটি ডলার। এই বকেয়া ডলার সংকটের কারণে পরিশোধ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। যে কারণে চীন থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ডলার সংকট মেটাতে কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেও সমাধানে আসতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
জটিলতা কাটাতে ২৭ এপ্রিল বিসিপিসিএল কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সচিবকে চিঠি দিয়েছিল। এর আগেও সংশ্লিষ্টদের বকেয়া অর্থ পরিশোধ করতে তাগিদ দিয়েছিল বিসিপিসিএল। এসব চিঠি চালাচালি পর ৩ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়। এরপরও পায়রা বিদ্যুতের কাছে ৩৬ কোটি ডলার পাবে সিএমসি। বড় অঙ্কের এই অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত পায়রা তাপবিদ্যুৎকে বাকিতে কয়লা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিএমসি।
এ প্রসঙ্গে বিসিপিসিএলের একজন প্রকৌশলী বলেন, পায়রা থেকে দৈনিক গড়ে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। যা সরাসরি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। ফলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা পেত দেশের মানুষ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হলে সারা দেশেই এর প্রভাব পড়বে।
২৯ মে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ খোরশেদুল আলম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, কয়লা সংকটের কারণে ৩ জুন পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, শুধু পায়রা নয়, জ্বালানি সংকটে দেশের একাধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। মূলত ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না। এ সংকট কাটাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছি।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থা সঠিক পরিকল্পনায় চললেও প্রাথমিক জ্বালানির ধারাবাহিক সরবরাহ চ্যালেঞ্জে রয়েছে।
ঘাটতি মেটাতে দেশের বাহির থেকে বিদ্যুৎ আনাসহ বিকল্প বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
শনিবার দুপুরে সাভারের খাগান এলাকায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা ল্যাবরেটরি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এলসি খুলতে দেরি হয়েছে। এ কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে। আমি মনে করি যে এতে কিছুটা জনদুর্ভোগ হচ্ছে। লোডশেডিং বেড়ে গেছে কয়েকটা বিদ্যুৎকেন্দ্র কাজ না করাতে।’