প্রাইভেট গাড়িতে বসে অঝরে কাঁদছেন এক নারী। তাকে নামিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়ে বারবার বলছেন ‘আমার ক্লাস আছে একটু পর, প্লিজ যেতে দেন। আমাকে নামিয়ে দিন এখানে। প্লিজ আমি ক্লাসটা মিস দিতে পারব না। প্লিজ।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবে আর্তনাদ আর আকুতি জানালেও মন গলেনি ওই ব্যক্তির (একজন পুরুষ)। উত্তরে তিনি (পুরুষ) ওই শিক্ষার্থীকে শাসাতে থাকেন। এসময় তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমার সঙ্গে ঠিক মতো কথা বলতে হবে। ঠিকমতো পড়ালেখা করো; লাইফ নষ্ট করতেছো।’
গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ঘটনার একাধিক ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে। যার একটিতে এমন কথোপকথন শোনা গেছে। ভিডিওতে পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেলেও তাকে দেখা যাচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভিডিওর ওই নারী রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর পুরুষ কণ্ঠের ওই ব্যক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দাতা সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ছাত্রীর সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্যের এমন আচরণের বিষয়টি ফাঁস হওয়ায় ফুঁসে উঠেছেন অভিভাবকরা। তারা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন।
এদিকে ছাত্রীর সঙ্গে এমন ঘটনার জেরে ৩১ মে পরিচালনা পর্ষদের সভায় ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মমতাজ বেগমকে দিয়ে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এরইমধ্যে কমিটির সদস্য তার কাজ শুরু করেছেন।
শিক্ষাসফরের পিকনিকে ঘটনার সূত্রপাত
গভর্নিং বডির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সম্প্রতি খন্দকার মুশতাক আহমেদের বাসায় ‘পিকনিকের’ আয়োজন করেন অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী। সেখানে কয়েকজন ছাত্রীকে খন্দকার মুশতাকের পরিচয় করিয়ে দেন। এই পরিচয়ের সূত্র ধরে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করেন তিনি। বিষয়টি শিক্ষক ও অন্যান্য ছাত্রীদের নজরে আসে। এরপর ভিডিও ভাইরাল হয়। অভিযুক্ত সদস্যকে দুইমাসের জন্য ‘নিষিদ্ধ’ করেছে প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত ১৮ মার্চ পিকনিকের অনুষ্ঠানে মুশতাককে গলায় মালা পরান এবং মুখে তুলে খাওয়ান কলেজের অধ্যক্ষ। অনুষ্ঠানের ছবিতেই তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অধ্যক্ষের ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ার কারণে শিক্ষাসফর করা হয় মুশতাকের বাড়িতে। তাছাড়া অভিভাবক সদস্য (প্রাথমিক) শাহদাৎ ঢালীর মালিকানাধীন ‘সেইফ’ কোচিং সেন্টারে প্রায় এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ অভিবাবকদের।
ছাত্রীর সঙ্গে গভর্নিং বডির সদস্যের ভিডিও ভাইরালের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ফোরাম অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, সরকারি ভর্তি নীতিমালা অমান্য করে গভর্নিং বডি এবছর লটারি ছাড়া শিক্ষার্থীপ্রতি পাঁচ থেকে ছয়লাখ টাকা নিয়ে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করেছেন। তাছাড়া এনটিআরসিএ’র বাইরে সরকারি অনুমোদন ছাড়া শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর এভাবে কোটি কোটি টাকা নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্য হয়েছে।
এদিকে ১ জুন অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রোস্তম আলী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের দাতা সদস্য ষাটোর্ধ্ব খন্দকার মুশতাক আহমেদ প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার ১৭ বছর বয়সী ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রেখেছেন। একপর্যায়ে অভিভাবকদের চাপে সম্প্রতি তাকে বিয়ে করতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। এটি তার তৃতীয় বিয়ে।
এদিকে এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উত্তেজনা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে জানিয়েছেন। তবে তৃতীয় বিয়ে করার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন খন্দকার মুশতাক। তিনি বলেন, ‘এটি পুরোপুরি মিথ্যা। আমার সংসার আছে। আমি কেন ছাত্রীকে বিয়ে করতে যাব?।’
গভর্নিং বডির অন্যতম সদস্য গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেন, ‘দুটি ভিডিও ভাইরালে গভর্নিং বডিকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।’
সম্প্রতি অবসরে যাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দীর্ঘ ২৫ বছরের বেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলাম, কিন্তু কোনোদিন এমন ঘটনা দেখিনি শুনিনি। আজ যেসব ভিডিও দেখলাম, আর প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে যা শুনছি খুব কষ্ট হয়। আমি তো এখন অবসরে, আমার কিছু করারও নেই। দায়িত্বশীলরা দ্রুত এগিয়ে না এলে ধ্বংস হয়ে যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি।
শিক্ষাসফর গভর্নিং বডির সদস্যের বাড়িতে কেন করা হলো এবং ছাত্রীদের সঙ্গে খন্দকার মুশতাকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোনো মন্তব্য করেননি অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী। তবে তিনি বলেন, ‘আমরা যে মুহূর্তে জানতে পেরেছি একটি ঘটনা হয়েছে, তখন এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে চিঠি ইস্যু করেছি। তিনি তদন্ত রিপোর্ট দেবেন।’
বন্ধুত্বের সুযোগে খন্দকার মুশতাক আহমেদ এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। বন্ধু মানে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। আমি আমার হাজব্যান্ড এবং খন্দকার মুশতাক আমরা সহপাঠী ছিলাম। কে কী বললো তাতে আমার কিছু আসে যায় না।’
তদন্তের অগ্রগতি জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মমতাজ বেগমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।