দখল আর দুষণে সাতক্ষীরার ২৭টি নদী: খননের নামে চলছে হরিলুট

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরা: দখল আর দুষণে ভরাট হতে চলেছে সাতক্ষীরা জেলার রক্ষাকবচ ২৭টি নদী। ইত্যোমধ্যে এসব নদীতে জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ফারাক্কা বাঁধ, অপরিকল্পিত ব্রিজ স্লুইসগেট-বাঁধ নির্মাণসহ চর দখল করে নদী শোষনের ফলে উপকূলীয়া এ জেলার ছোট-বড় ২৭টি নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। নদ নদী খনন ও রক্ষায় বছরজুড়েই নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও ক্ষমতার আশীর্বাদে দখল ও দূষণ শেষ পর্যন্ত প্রায় অপ্রতিরোধ্যই থেকে যায়। এতে ধীরে ধীরে নদী শুকিয়ে যায়। খনের নামে যেটুকু কাজ হচ্ছে তার বেভির ভাগ বরাদ্দই যাচ্ছে লুটেরাজের পকেটে। জেলার কপোতাক্ষ, কাকশিয়ালী, মরিচচাপ, যমুনা, সোনাই, বলুয়া, গলঘেঁষিয়া, গুঁতিয়াখালী, সাপমারা নদীসহ ছোট-বড় ২৭টি নদ-নদীর অধিকাংশ দখল ও দূষণের কারণে মরা খালে পরিণত হয়েছে। জেলার ৪৬ কিলোমিটার নদীর বুকে ইটভাটা, অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় জোয়ার-ভাটা বছর দশেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবেশবিদদের মতে, নদীর বুকে পিলার স্থাপন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য ব্রিজ নির্মাণের ফলে বেতনা নদী এক দশকের মধ্যেই মরণদশায় নিপতিত হয়েছে।
একসময় এসব নদীতে চলত লঞ্চ, স্টিমারসহ বড় বড় গয়নার নৌকা। গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ মানুষ নৌকায় চড়ে জেলা সদরে আসত নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে। ব্যবসা-বাণিজ্য আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে নদী গুলো জেলা সদরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত থাকায় নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কপোতাক্ষ নদ ঘিরে পাটকেলঘাটা বাজারে সারা বছরই ব্যবসা বাণিজ্য হতো। এখন সেসব ব্যবসা আর নেই। এখান থেকে মাত্র ১৫-২০ বছর আগেও নদীর হিংগ্র থাবায় বর্ষা মৌসুমে দুই কূল ভাসিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হতো। নদীতে মাছ ধরে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করত। আর শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহার করে কৃষক জমিতে ফলাত সোনার ফসল। কালের আবর্তনে দখল আর দূষণের কবলে পড়ে আশীর্বাদের সেই নদী এখন মৃত।
৫৭ বছরে শুকিয়ে গেছে দেশের ১৫৮ নদী। উত্তর অঞ্চলের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও বড় বড় নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। নদীর বুকে বসত ঘর, বেড়িবাঁধ দিয়ে মৎস্যচাষ সহ নানা কারণে সাতক্ষীরা ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে সংলগ্ন খুলনা ও যশোর এলাকার কয়েক নদী এরই মধ্যে মারা গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রথম এক দশক পর্যন্ত নদীগুলো প্রবহমান থাকলেও আশির দশক থেকে এর মরণদশা শুরু হয়। ফলে পানি নিষ্কাশনের অভাবে বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট হচ্ছে । দুটি গবেষণার রির্পোটে বলছে দেশে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২২ বছরে (২০০০ থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
উত্তরণের পরিচালক শহিদুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা, শালিখা, শালিতা, হামকুড়া, চুনা ও হাতিটানার মতো তীব্র স্রোতের নদী এখন শুকিয়ে বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। মূলত অপরিকল্পিতভাবে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ক্রমাগত নদ-নদী ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায়, তা বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ এর ফলে খাদ্য ঘাটতিও বেড়ে যাবে বহুল পরিমাণে এবং হুমকির মধ্যে পড়বে বিশ্বের জীববৈচিত্র্য৷পলি জমা, উজানের সময় নদী তীরে জলের প্রত্যাহার, নির্বিচার দখল ইত্যাদির কারণে, আজ দেশের অসংখ্য নদীর অস্তিত্বই আশংকাজনক ৷ এছাড়া সুন্দরবন ও সাগর বিধৌত সুজলা-শ্যামলা সাতক্ষীরা জেলায় ২৭টি নদ-নদীর তীরে গড়ে উঠা শহর বন্দর ও জনপদে স্বেচ্ছাচারীভাবে নদীর তীরে এমনকি চর দখল করে নদীর মধ্যেও গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি, দোকানপাট, ইটভাটা, কৃষিখামার। পানি প্রবাহ হারিয়ে মুমূর্ষ দশায় নদীগুলোর এ দখলদারিত্ব নদীর অস্তিত্বকে আরেক দফা হারিয়ে দিয়েছে। ফলে জেলার ২/১ নদী বাদে
সূত্র মতে, সাতক্ষীরার নদ-নদীগুলোর মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় দখল দারিত্ব ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত স্লুইসগেট। এছাড়াও উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, অপরিকল্পিত স্লুইসগেট ছাড়াও এ অঞ্চলের নদীর ওপর ৪৮টি সেতু- নদী মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইস গেট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এর মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় ও অবৈধ দখল দারিত্বের কারণে পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
কাকশিয়ালী নদীরও নাব্যতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বেতনা নদী তার নাব্য হারিয়ে পুরোপুরি একটি মৃত খালের রূপ নিয়েছে। অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে মরিচ্চাপের।এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ খনন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে আর আগের মতো জোয়ার-ভাটা হয় না। কোনোভাবে নদীটি মরা খালের মতো বেঁচে আছে। বেতনা নদীসহ মরিচ্চাপ ও যমুনা খনন করা হলেও দখল দারিত্বের কারণে তা র্পূর্বের অবস্থায় ফেরেনি।
বেতনা নদী বা বেতনা-কোদালিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এই নদী ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৯১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৫৫ মিটার হলেও এখন নদীটি শুধুই স্মৃতি হতে চলেছে। নদীটিতে এখন পানি প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিনেরপোতা থেকে মাছখোলা পর্যন্ত নদীর তীরে ও বুকে চর দখল করে অসংখ্য ইটভাটা গড়ে তুলেছেন প্রভাবশালী কিছু ভাটা মালিক। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নীরব থাকায় তাদের বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন তুলছেন এলাকাবাসী। কলারোয়া উপজেলা থেকে সাতক্ষীরার সদর উপজেলার মাছখোলা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে নদীর তীর ও নদীর বুক দখল করে প্রায় ৩৫টির মতো ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ভাটা মালিকের কারণে বেতনা নদী মরণদশায় পরিণত হয়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশনের অভাবে বিপাকে পড়তে হয় কৃষক ও এলাকাবাসীকে।

 

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।