আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে সাতক্ষীরাসহ উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ। বসবাসের অনুপযোগী হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রচণ্ড গরম আর সুপেয় পানি সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। কয়েক যুগের মধ্যে এমন পরিস্থিতর সম্মুখীন হয়নি এ অঞ্চলের মানুষ। ক্রমবর্ধমান দুর্যোগের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষের খাদ্যসংকট, স্বাস্থ্যঝুঁকি, জীবিকার উৎস হ্রাস, অপুষ্টি, সুপেয় পানির অভাবে রোগব্যধি বৃদ্ধিসহ প্রতি বছর প্রচুর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। গবেষণার রিপোর্টে বলছে, উপকূলীয় অঞ্চলে গত ৩৫ বছরে লবণাক্ততা পূর্বের তুলনায় ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উপকূলের ৭৩ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। লবণাক্ততার কারণে কৃষি ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে। এছাড়া লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে এ এলাকায় বসবাসকারী গর্ভবতী মায়েদের প্রি-একলেম্পশিয়া, উচ্চরক্তচাপ ও জরায়ু সংক্রমণ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। প্রতি বছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। একুশ শতকে এসে যেখানে বিভিন্ন প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে মানুষের জীবনমান বেড়ে চলেছে, সেখানে উপকূলের মানুষের জীবন কাটছে দুর্দশায় ও আশঙ্কায়। সংকট মোকাবিলায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি সংশ্লিষ্টদের।
দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের ৭০ ভাগেরও বেশি বয়ে যায় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার ওপর দিয়ে। কিন্তু এ অঞ্চলের অবকাঠামো খুবই দুর্বল। বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। এখনো অনেক স্থান রয়েছে, যা সামান্য জোয়ারেই ভেঙে এলাকা প্লাবিত হবে। এ অঞ্চলের মানুষের ঘরবাড়ি, কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি, যা দুর্যোগ সহনশীল নয়। জনসংখ্যার অনুপাতে আশ্রয়কেন্দ্র খুবই কম। প্রতিটি দুর্যোগে ভেসে যায় মানুষের তিলেতিলে গড়া সঞ্চয় ও সম্পদ। স্থানীয়রা বলছেন, আগের চেয়ে নদী এবং পুকুরের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আর এই লবণাক্ত পানি ব্যবহার করায় নানা রোগে ভুগছেন অনেকে। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। পিতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে অনত্র আশ্রয় নিচ্ছে অসংখ্য মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন আর সমুদ্রপৃষ্টের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন। কৃষি, জনস্বাস্থ্য, বাসস্থান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে নানামুখী বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। চলমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে না পারলে উপকূলীয় অঞ্চলে কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে বিশেজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত জার্নালের তথ্যানুযায়ী, বিগত ৩৬ বছরে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ২ হাজার দশমিক ৮১ হেক্টরে। বৃদ্ধির হার শতকরা ২৬.৭ ভাগ। ১৯৭৩ সালে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ লাখ ৩৩ হাজার দশমিক ৪৫ হেক্টর। ২০০০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ ২০ হাজার দশমিক ৭৫ হেক্টর। মাত্র এক যুগেরও কম সময়ের ব্যবধানে ২০০৯ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার দশমিক ২৬ হেক্টর, অর্থাৎ ৯ বছরে বাড়ে ৩৫ হাজার দশমিক ৫১ হেক্টর (বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ)। ২০২২ সালে এসে তা দাঁড়ায় ১২ লাখ হেক্টরের কাছাকাছি।
দেশের উৎপাদিত খাদ্যের এক বিরাট অংশই ফলতো উপকূলীয় এ এলাকাগুলোয়। লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ওইসব অঞ্চলে কৃষি আবাদ ব্যাহত হওয়ায় দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি গবেষণার মাধ্যমে লবণসহিষ্ণু জাত সম্প্রসারণ করে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদন এখনো খুবই সীমিত পরিসরে রয়েছে। সার্বিক সংকট মোকাবিলায় অভিযোজন কৌশল এ মুহূর্তেই বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ঋতুর বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা ইত্যাদি বাড়ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলায় এর প্রভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) সাতক্ষীরা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. বাবুল আক্তার বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় দিন দিন লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলের মাটি ও পানি পরীক্ষা করে দেখেছি, মার্চ-এপ্রিলের পর থেকে ২০-২৫ ডিএস মিটার লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। এপ্রিলের আগে ১০-১২ ডিএস মিটার পাওয়া যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় ৮ ডিএস মিটারের নিচে লবণাক্ততা কখনো নামে না। লবণাক্ততা ৩-৪ ডিএস মিটার থাকলে ধান উৎপাদন কঠিন হয়ে যায়। নিয়মিত এই মাত্রার লবণাক্ততার মধ্যে মানুষ বসবাস করলে শারীরিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা হয়। প্রতি বছর যেভাবে লবণাক্ততা বাড়ছে তাতে একসময় উপকূলীয় এলাকা বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে। এজন্য লবণ সহিষ্ণু বিভিন্ন জাতের গাছ উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছি আমরা।’
শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা অঞ্চলে বসবাসরত আনিচুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতি বছর গরমের সময় দিন দিন গরম যেন বাড়ছেই। আবার ভারী বৃষ্টিপাত হলে আমাদের বাসার নিচে পানি জমে যায় আমাদের দোকান তলিয়ে যায়, যা আগে কখনোই দেখিনি।’ আগে নভেম্বর-ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে অনেক ঠাণ্ডা পড়ত। স্কুলে পরীক্ষার সময় শীতের কারণে যেতে কষ্ট হত। এখন ডিসেম্বর মাসেও আগের মতো ঠাণ্ডা এখন পড়ে না। আমাদের পরিবারে অনেক সদস্য চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই বলছেন জলবায়ু বদলের কারণে এসব হচ্ছে। ‘সরকারের কাছে সংকট থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা জানিয়ে আনিচুর বলেন, “নিরাপদ খাদ্য এবং পানির সুব্যবস্থা করা খুব জরুরি। বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝায় গর্ভবতী মা এবং বৃদ্ধ লোকেরা, প্রতিবন্ধীরা নানা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তাদের সেই সময়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সাহায্য দরকার আমাদের।’
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …