॥ ফারাহ মাসুম ॥
ঈদের পর বিরোধীপক্ষের সর্বাত্মক আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা তাড়া করছে সরকারি দল আওয়ামী লীগকে। এরই মধ্যে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের এক দফা চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এর ভিত্তিতে ঈদুল আজহার পর লাগাতার কর্মসূচি দেবে দলটি। এ লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনের পথনকশাও প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী গত ১০ জুনের সমাবেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য চূূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। অন্য বিরোধী জোট ও দলগুলো স্ব স্ব অবস্থান থেকে এজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। সরকারের কাছে থাকা তথ্যানুসারে, ঈদের পর বড় ধরনের আন্দোলনের সূচনা ঘটতে পারে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে উচ্চপর্যায়ে চলে যাওয়ায় মানুষের ক্ষোভ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রতি দেশি-বিদেশি ব্যাপক সমর্থনে এই এক দফার আন্দোলন সিদ্ধান্তকারী গণঅভ্যুত্থানে রূপ পাবার সম্ভাবনা শাসকদলকে শঙ্কিত করছে। অভ্যন্তরীণ চাপ এবং বাইরের চাপ একসাথে এলে সরকারের পক্ষে তা সামাল দেয়া কঠিন হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওয়াশিংটন সফরকালে বাংলাদেশ ইস্যুটি উত্থাপন করে এ ব্যাপারে ছাড় আদায় করবেন বলে ভরসা করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘ সময় ধরে নেয়া একটি নীতি হঠাৎ পরিবর্তনে কিছু করবে- এমন কোনো বিষয় বিশেষজ্ঞরা দেখতে পাচ্ছেন না। এর মধ্যে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বিধিনিষেধ আসার আশঙ্কা নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে। বিশ্ব সংস্থার এ বিষয়ক শীর্র্ষ কর্মকর্তা আগামী ২৫ জুন ঢাকা সফরে আসছেন। এ সময়ে যেকোনো কঠিন বার্তা আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক এক বৈঠকে এক দফা আন্দোলনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। এই এক দফা বাস্তবায়নে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে এর সাথে যুক্ত দলগুলোর সাথে শলাপরামর্শও এরই মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। সমঝোতা অনুসারে যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জোট ও দলগুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে একই দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। মূল এক দফার বাইরে দলগুলোর নিজস্ব দাবি সংযুক্ত হতে পারে। যার মধ্যে দলীয় নেতাদের মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনের মতো দাবি থাকতে পারে। বিএনপি রাজধানীতে বড় সমাবেশের মাধ্যমে এক দফার ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। একইভাবে কর্মসূচি ঘোষিত হতে পারে জামায়াত ও অন্য দলগুলোরও। সময় সময় আন্দোলনে যুক্ত শরিক দল, বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবী, দলের জেলা-মহানগর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিস্তারিত কর্মসূচি ও কর্মপন্থা চূড়ান্ত করা হবে।
এর মধ্যে ২১ জুন রাজধানীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে একটি সেমিনার করে বিএনপি। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, বিচারপতি খায়রুল হকের সংক্ষিপ্ত রায় এবং কোন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকার তা বাতিল করল এবং এখনো কেন নির্বাচনকালে এ ধরনের সরকার দরকার, তা তুলে ধরা হয়। সেমিনারে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা, সুধীসমাজের প্রতিনিধি ও পেশাজীবী নেতারা অংশ নেন। ইউরোপীয় সংসদের ৬ এমপি বাংলাদেশে মুক্ত, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলার পর এর গুরুত্ব নতুন মাত্রা লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও অনানুষ্ঠানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনের রোডম্যাপ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন সফল করার লক্ষ্য থাকবে। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল এগিয়ে আনার যে গুঞ্জন রয়েছে, সেটি মাথায় নিয়ে আন্দোলন পরিকল্পনায় বিকল্প রোডম্যাপও ঠিক করা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত অনুসারে মাঠের আন্দোলন যখন তুঙ্গে যাবে, তখন বিদ্যমান পরিস্থিতি বুঝেই যেকোনো কৌশল নির্ধারণ করবে দলটির হাইকমান্ড। তবে অতীতের মতো এবার আন্দোলন দীর্ঘসময় টেনে নেওয়া হবে না। অল্প সময় টার্গেট করে অলআউট মাঠে নামবে সব দল। আন্দোলনের শেষ ধাপে ঢাকা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসতে পারে। ওই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সংঘাত, সংঘর্ষ কিংবা প্রাণহানি হলে তাৎক্ষণিকভাবে কঠোর ও সর্বব্যাপী কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিরোধীপক্ষের।
বিএনপি এরই মধ্যে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা দিয়েছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। দলটি মনে করছে, তারা যদি দাবিতে অটল থাকে, জোরালো আন্দোলন আর নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো আরো কার্যকরভাবে পাশে দাঁড়াবে। তখন একতরফা নির্বাচনের ব্যাপারে নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। এমনকি এ নির্বাচন বন্ধের জন্য জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটতে পারে বলে প্রত্যাশা বিএনপি ও অন্য বিরোধীদলগুলোর। বিরোধীপক্ষের কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, শান্তিরক্ষা বাহিনীতে যদি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে বিধিনিষেধ আসে, তাহলে একতরফা নির্বাচন কোনোভাবেই সরকার করতে পারবে না।
এদিকে বাংলাদেশ যখন একটি নির্বাচনের কাছাকাছি আসছে এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, তখন বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা আবারও সামনে চলে এসেছে। বাংলাদেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং গণতন্ত্রকে সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৪ মে ২০২৩ তার নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করার পর থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতীয় মিডিয়ায় দুটি প্রশ্নের ওপর আলোচনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। প্রথমত, ভারত সরকারের প্রতি তার একতরফা সমর্থন অব্যাহত রাখবে কিনা। দ্বিতীয়ত, হাসিনার শাসন এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য হবে কিনা। এ ধরনের বিচ্যুতির ক্ষেত্রে, যে পক্ষ বিজয়ী হবেন, তারা অদূর ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করতে পারেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন।
আটলান্টিক কাউন্সিলে গত ১৬ জুন প্রকাশিত তাৎপর্যপূর্ণ লেখায় তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত মতামতের ধারাভাষ্য এবং সম্পাদকীয়তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক অস্বস্তি প্রকাশ হয় এবং এটি ভারতকে একটি ‘কঠিন অবস্থানে’ ফেলেছে বলে স্বীকার করা হয়। এ ভাষ্যগুলোয় মার্কিন পদক্ষেপকে ‘পেশি-বাঁকানো’ হিসেবে বর্ণনা করে অভিযোগ আনা হয় যে, এটি ‘একটি সার্বভৌম জাতির নির্বাচন এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এটি একটি কপট হস্তক্ষেপ।’ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে একমত বলে মনে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপটি হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে নেয়া। এ অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ১০ এপ্রিল থেকে দুবার বলেছেন। কিছু ভারতীয় ভাষ্যকার এমন পরামর্শ দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রকে’ সমর্থন করার এখনই সঠিক সময়। ভারতীয় ভাষ্যের সাধারণ বক্তব্য হলো, দিল্লিকে নিশ্চিত করতে হবে যে হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন। একজন বিশ্লেষক লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে জয়ী করতে সহায়তা করতে হবে।’ হাসিনার প্রতি অনভিপ্রেত সমর্থনের জন্য যে যুক্তিটি নিয়ে আসা হয়েছে, তা হলো ভারতের জাতীয় স্বার্থ। একজন ভাষ্যকারের ভাষায়, ‘হাসিনা শাসনকে সমর্থন করা ছাড়া ভারতের কোনো বিকল্প নেই।’ অন্যদিকে আরেকজন আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার তার ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতিকে এগিয়ে নেওয়ার চাবিকাঠি।”
আলী রীয়াজের মতে, ভারতীয় ভাষ্যকারদের যুক্তিতে তিনটি মূর্খতা সহজেই ধরা পড়ে; তারা যখন ভিসানীতিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ হিসেবে বর্ণনা করে তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছে, তখন তারা সুবিধাবাদীর মতো এটি উপেক্ষা করেছে, ভারত কীভাবে গত এক দশকে বাংলাদেশে তার একতরফা প্রভাব বজায় রেখেছে এবং বিদ্রƒপাত্মকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্যকে উপেক্ষা করে বর্তমান হাসিনা সরকারের পাশে থেকেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার বার নিশ্চিত করেছে, তারা কোনো বিশেষ দলের পক্ষে নয়, বরং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছে, ভারতীয় মিডিয়া এটিকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষে হস্তক্ষেপ করা হিসেবে চিহ্নিত করে চলেছে। তারা পরোক্ষভাবে এটিই বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) বিজয়ী করবে। তাদের এ উদ্বেগ বাংলাদেশ গত চৌদ্দ বছরে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জন করেছে এবং হাসিনাকে বেশিরভাগ জনসংখ্যার সমর্থন রয়েছে মর্মে দাবির সাথে মেলে না। এছাড়া বিএনপির বিজয়ে জঙ্গিবাদ পুনরুজ্জীবিত হবে- এমন যুক্তি বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থানের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মেলে না।
আটলান্টিক কাউন্সিলের এ নিবন্ধে বলা হয়, জো বাইডেনের প্রেসিডেন্সির সাথে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি পেশাগত ভিত্তি। এ কারণে দেশটির বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের অভিজাত পুলিশ বাহিনী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আর ২০২২ ও ২০২৩ সালের শুরুর দিকে এই গুরুতর সতর্কবাণী স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হয় যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন দ্বারা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এতে বলা হয়, ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফোকাস বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য বাড়ায়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি গাজর-লাঠিনীতি গ্রহণ করেছে বলে মনে হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দিয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের ক্ষয় সংক্রান্ত উদ্বেগও ছিল একই সাথে। নয়াদিল্লির এ প্রচেষ্টায় না থাকার মধ্য দিয়ে এটি প্রতীয়মান হয় যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশকে ভারতীয় লেন্স দিয়ে দেখছে না।’
আলী রীয়াজের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, গণমাধ্যমে তীব্র আলোচনা সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি অথবা যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সম্পর্কে নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালের বিপরীতে, ভারত ইউএস-বাংলাদেশ ইস্যুকে তার সরকারি দৃষ্টি থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর, ভারতের প্রতিক্রিয়া নীরব ছিল, যদিও বাংলাদেশ সিদ্ধান্তটি ফিরিয়ে নিতে ভারতের সাহায্য চেয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন, এ বিষয়ে নয়াদিল্লির সাথে পরামর্শ করা হয়েছিল কিনা। অথচ এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে, নয়াদিল্লির সামনে কখনো ওয়াশিংটন বিষয়টি উত্থাপন করেছে।
আলী রীয়াজ বলছেন, গণতান্ত্রিক ক্ষয় রোধের দাবিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ সত্ত্বেও নয়াদিল্লি স্থিতাবস্থায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। গত দেড় বছরে মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে যখন জোরালো বার্তা পাঠাচ্ছিলেন, তখন ভারতের সরকারি বার্তা ছিল হাসিনার প্রতি সমর্থন প্রদর্শন। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় খাতরের সফর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্করের এপ্রিল ও মে মাসে ঢাকা আসা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া গ্রুপ অব টোয়েন্টিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো এ ধারণা দেয় যে, ‘নয়াদিল্লি যেকোনো উপায়ে হাসিনাকে জেতাতে চায়।’ আগামী মাসগুলোয় বাইডেন প্রশাসনকে তার বাংলাদেশ নীতি নরম করতে রাজি করার জন্য ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তার লিভারেজ ব্যবহার করবে কিনা, এখন তা দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে পর্যবেক্ষণকারী অনেক আমেরিকানের মতো আলী রীয়াজও মনে করেন, ভারত বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিরোধিতা করছে না, যা বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা এবং চীনের প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করার জন্য হাসিনাকে দুর্বল এবং ভারতের ওপর আরও নির্ভরশীল করে তুলবে। ঢাকার শাসন ব্যবস্থা যত বেশি দুর্বল হবে, নয়াদিল্লি তত বেশি সুবিধা পাবে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং এই টানাপড়েনে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব বিবেচনা করে ভারত ক্ষুব্ধভাবে স্বীকার করছে যে, এতে দিল্লি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গৌণ বহিরাগত অভিনেতা হয়ে উঠছে। প্রতিবেশী দেশগুলো আর ভারতকে শক্তিশালী খেলোয়াড় মনে করে না।
চলতি সপ্তাহে ওয়াশিংটনে বাইডেন-মোদি শীর্ষ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে বাংলাদেশ ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে কিনা- এ প্রশ্নে আলী রীয়াজ মনে করেন, বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশকে কম তাৎপর্যপূর্ণ মনে হতে পারে। তবে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনাগুলো নিঃসন্দেহে নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশ মনোযোগ পেয়েছে। তবে ভারতকে জানানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব যে, দেশটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করবে এবং তার বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া নীতি নয়াদিল্লির সাথে তার সম্পর্কের দ্বারা অবয়ব পাবে না। ভারত কীভাবে তার বৈশ্বিক আকাক্সক্ষা এবং আঞ্চলিক পছন্দের মধ্যে উত্তেজনার সমন্বয় করে, তা প্রকৃতপক্ষে সামনে প্রকাশ পাবে।
আলী রীয়াজের বক্তব্য বা বিশ্লেষণ নিছক একজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য নয়, এতে আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক ও আইনপ্রণেতাদের চিন্তা ও উদ্বেগের প্রতিফলন দেখা যায়। ফরেন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত সাম্প্রতিক তাৎপর্যপূর্ণ লেখা এবং বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক উপদূতাবাস প্রধান জন ড্যানিলোভিজের সাউথ এশিয়ান পারসপেক্টিভে লেখার মূল সুরের সাথে এর অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জন ড্যানিলোভিজের লেখার তাৎপর্যপূর্ণ অনুসিদ্ধান্তটি হলো, ‘ঢাকায় নীতিনির্ধারকদের সর্বশেষ মার্কিন নীতি উদ্যোগের প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় সতর্কতার সাথে তাদের হাত কতদূর যেতে পারে, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। বাইডেন প্রশাসন স্পষ্ট করেছে, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র সম্পর্কিত মূল্যবোধের এজেন্ডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার যত তাড়াতাড়ি তাদের নিজস্ব ক্ষমতা কতটা তা বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করবে, ততই সংশ্লিষ্ট সবার জন্য মঙ্গল হবে। সব কিছুতে যাওয়ার এবং কাউকে ‘ব্লাফ কল’ করার বিকল্পটি অনেক কম আনন্দদায়ক ফলাফলের দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
এ বিষয়টিতে হাসিনা সরকারের চীন-রাশিয়া অক্ষে যাবার হুমকি এবং ব্রিকসে যোগদানের আবেদন করার উদ্যোগের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে হয়। সম্প্রতি চীন ও রাশিয়া উভয়ে সরকারের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারের পাশে থাকার কথা বলেছে।
এদিকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অপারেশনের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রোইক্স ঢাকায় আসছেন ২৫ জুন। এ সফর নিয়ে সরকার এবং বিরোধীপক্ষ নানা হিসাব-নিকাশ করছে। বিশেষ স্থানগুলোয়ও আলোচিত হচ্ছে শান্তি মিশনে নিষেধাজ্ঞা আসছে কিনা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ইস্যুতে জাতিসংঘকে চিঠি লিখে বাংলাদেশ থেকে শান্তিমিশনে লোক নেওয়ার আগে তাদের অতীত পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে, শান্তি মিশনে যাদের নেওয়া হচ্ছে, তারা অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে কিনা, তা যাচাই বাছাই করে তারপর শান্তি মিশনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সে অনুযায়ী আন্ডার সেক্রেটারি ল্যাক্রোইক্স ঢাকা সফরে যদি কোনো নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে যান, তখন পরিস্থিতির ওপর পড়তে পারে এর ব্যাপক প্রভাব।
এরই মধ্যে ৬ র্যাব কর্মকর্তার ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এসেছে, ৬ রিপাবলিক্যান কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশ নিয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চিঠি দিয়েছেন, ৬ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট সদস্য ইউরোপীয় কমিশনের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রধানের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছেন, ৬ প্রভাবশালী ডেমোক্রেট কংগ্রেসম্যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে মুক্ত, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ ভিসানীতি ঘোষিত হবার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিষয়ে আরো একটি নিষেধাজ্ঞা আসার বিষয় নিয়ে আলোচনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামী মধ্য জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট হতে পারে বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে ঘটনাবহুল সময়।
