॥ মাওলানা এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ ॥
ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। এমন দিনকে ঈদ বলা হয়, যেদিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বার বার ফিরে আসে। এই শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তাঁর বান্দাদের নিয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা ধন্য করেন ও বার বার তাঁর ইহসানের দৃষ্টি দান করেন। যেমন রমাদানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। সদকায়ে ফিতর, হজ-জিয়ারত, কুরবানির গোশত ইত্যাদি নিয়ামত তিনি বার বার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নিয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগতভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।
ইসলামে ঈদের প্রচলন : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহর প্রতি নিয়ামত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. যখন মদিনায় আগমন করলেন, তখন মদিনাবাসীদের দুটি দিবস ছিল, যে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন এ দু’দিনের কী তাৎপর্য আছে? মদিনাবাসীগণ উত্তর দিলেন, আমরা জাহেলি যুগে এ দুদিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দু’দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দুটি দিন দিয়েছেন। তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ (সুনানে আবু দাউদ)। শুধু খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে দুটি দিন ছিল আল্লাহ তায়ালা তা পরিবর্তন করে এমন দুটি দিন দান করলেন, যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, তাঁর জিকির, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে শালীন আমোদ-ফুর্তি, সাজসজ্জা, খাওয়া-দাওয়া করা হবে। আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ গ্রন্থে ইবনে জারীর রা. বর্ণনা মতে, দ্বিতীয় হিজরী সনে রাসূল সা. প্রথম ঈদ পালন করেছেন।
ঈদে করণীয়
ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কিন্তু আমরা এ দিনকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহণ করি না। এ দিনে অনেক কাজ আছে, যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। নিচে করণীয়গুলো আলোচনা করা হলোÑ
ঈদের সালাত আদায় করা : ঈদের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈদের সালাত আদায় করা। প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার বান্দা সালাত আদায়ের মাধ্যমে বেশি আনন্দিত হয়ে থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘নবী কারীম সা. ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু’রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোনো নামাজ আদায় করেননি।’ (সহীহ বুখারী)। ঈদের সালাতে মহিলাদের শামিল করানোর বিষয়ে হাদিসে বলা হয়েছে, উম্মে আতিয়া রা. বলেন, ‘আমাদের রাসূলুল্লাহ সা. আদেশ করেছেন আমরা যেন মহিলাদের ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় সালাতের জন্য বের করে দেই; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবর্তী ও গৃহবাসীনীসহ সকলকেই। কিন্তু ঋতুবর্তী (ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে) সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে, তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের দোয়া প্রত্যক্ষ করতে অংশ নেবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মাঝে কারো কারো ওড়না নেই (যা পরিধান করে আমরা ঈদের সালাতে যেতে পারি)। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘সে তার অন্য বোন থেকে ওড়না নিয়ে পরিধান করবে।’ (সহীহ মুসলিম : ২০৯৩)।
ঈদের দিন গোসল করা : ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে ওমার রা. থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।’ (সুনানে বায়হাকী : ৫৯২০)।
পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া : আর ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া হল সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সুন্নত হলো ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।’ (সুনানে আত তিরমিযী)। উভয় পথের লোকদের সালাম দেয়া ও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য যে পথে যাবে, সে পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরে আসা। হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নবী কারীম সা. ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন।’ (সহীহ বুখারী)।
ঈদের দিনে খাবার গ্রহণ : ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা এবং ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কুরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম সা. ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না।’ (সুনানে আত তিরমিযী)।
ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা : ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। যেমন- (ক) হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামগণ ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন : ‘তাকাব্বাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা’ অর্থ- আল্লাহ তায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। (খ) ‘ঈদ মোবারক’ ইনশাআল্লাহ। (গ) ‘ঈদুকুম সাঈদ’ বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
দুই ঈদে তাকবির পাঠ করা : তাকবির পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবির হলো, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমার রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সা. ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবির পাঠ করতেন।’ (মুসতাদরাক)। যখন সালাত শেষ হয়ে যেত, তখন আর তাকবির পাঠ করতেন না। বিশেষভাবে ঈদগাহের উদ্দেশে যখন বের হবে ও ঈদগাহে সালাতের অপেক্ষায় যখন থাকবে, তখন গুরুত্ব সহকারে তাকবীর পাঠ করতে হবে। আর সুন্নত হলো মসজিদ, বাজার, রাস্তাঘাটসহ সর্বত্র উচ্চৈঃস্বরে তাকবির পাঠ করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মানুষ এ সুন্নতের প্রতি খুবই উদাসীন। আমাদের সকলের কর্তব্য হবে এ সুন্নতটি সমাজে চালু করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো।
আর ঈদুল আজহার তাকবির শুরু হবে নবম জিলহজের ফজর থেকে আর শেষ হবে তেরো জিলহজের আসর নামাজের ফরজের সালাম ফেরানোর পর পর্যন্ত। যারা হজ পালনে রত নয় তারা এ নিয়মে তাকবির পাঠ করবেন। আর যারা হজ পালনে আছেন, তারা ঈদের দিনে জোহরের নামাজ থেকে তাকবির শুরু করবেন। কেননা এর পূর্বে তারা তালবিয়া পাঠে ব্যস্ত থাকবেন। (ফাতহুল বারী ২য় খণ্ড)।
নতুন বা পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করা : ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। এ দিনে সকল মানুষ একত্রে জমায়েত হয়, তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত হলো তার প্রতি আল্লাহর যে নিয়ামত, তা প্রকাশ করণার্থে ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়স্বরূপ নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর বান্দার ওপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ (সহীহ আলজামে : ১৮৮৭)। ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন, ‘নবী কারীম সা. দুই ঈদেই ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।’ (যাদুল মায়াদ)।
ঈদের খুতবা শ্রবণ করা : ঈদের খুতবা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবী কারীম সা.-এর সাথে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের সালাত শেষ করলেন, বললেন : আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভালো লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে।’ (সুনান আবু দাউদ)।
দোয়া ও ইস্তেগফার করা : ঈদের দিনে আল্লাহ তায়ালা অনেক বান্দাহকে মাপ করে দেন। মুয়ারিরক আলঈজলী রহ. বলেন, ঈদের এ দিনে আল্লাহ তায়ালা একদল লোককে এভাবে মাফ করে দেবেন, যেমনি তাদের মা তাদের নিষ্পাপ জন্ম দিয়েছিল। নবী কারীম স. এরশাদ করেন, ‘তারা যেন এই দিনে মুসলিমদের জামাতে দোয়ায় অংশগ্রহণ করে।’ (লাতাইফুল মায়ারিফ)।
মুসাফাহা ও মুআনাকা করা : মুসাফাহা ও মুআনাকা করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, ‘একদা হাসান ইবনে আলী রা. নবী কারীম সা. এর নিকট এলেন, তিনি তখন তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং মুআনাকা (কোলাকুলি) করলেন।’ (শারহুস সুন্নাহ)
ঈদুল ফিতরে ফিতরা ও ঈদুল আজহায় কুরবানি দেয়া : রমজান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্যসামগ্রী দান করা হয়ে থাকে, শরিয়তের পরিভাষায় তাকেই জাকাতুল ফিতর বা ফিতরাহ বলা হয়ে থাকে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সাদকায়ে ফিতর এক “সা” খেজুর অথবা এক “সা” যব নির্ধারণ করেছেন এবং তা নামাজে যাওয়ার পূর্বে আদায় কবার হুকুম দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী)।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সা. এরশাদ করেন, যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে অথচ সে কুরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা)। ইমাম ইবনে মাজাহ রহ. বলেন, হাদীসটি কুরবানি ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিদের জন্য কঠিন ধমকি। আর এমনটি হয় ওয়াজিব তরককারীদের ক্ষেত্রে। হাদীসটিকে ইমাম হাকিম সহিহ বলেছেন। ইমাম যাহবী রহ.তালখিসেও সহীহ বলেছেন। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি রহ. ফাতহুল বারিতে হাদিসটির সনদকে সহীহ বলেছেন। আল্লামা আইনি রহ. বলেন, হাদিসটির সনদ বুখারী-মুসলিমের সমতুল্য। আব্দুল্লাহ বিন আইয়াশ মুসলিমের বর্ণনাকারী, তাই এতে আপত্তিকারীদের আপত্তি গৃহীত হবে না ।
এতিম ও অভাবীকে খাবার খাওয়ানো : এতিমের খোঁজখবর নেয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কুরআনে বলা হয়েছে, তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। (সূরা আদ দাহর : ৮)।
আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়া : ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে রাসূল স. বলেছেন, ‘যে আখিরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে।’ (সহীহ বুখারী)।
প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেয়া : ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, এতিম, মিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (সূরা নিসা : ৩৬)।
মন-মালিন্য দূর করা : জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারো সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মন-মালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’ (সহীহ মুসলিম)।
আনন্দ প্রকাশ করা : ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যেখানে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দু’টি ছোট মেয়ে গান গাইছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে আবু বকর রা. ঘরে প্রবেশ করে এ বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ (সহীহ বুখারী)।
ঈদে যা বর্জনীয়
ঈদ মুসলিম জাতির গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। আর আমাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমরা ঈদ পালনে অনেকে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হচ্ছি, যা আমাদের বর্জন করা দরকার। ঈদে বর্জনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো-
বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন : বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। আবদুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ (আবু দাউদ : ৪০৩৩)।
নারীদের খোলামেলা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের না হওয়া : ঈদের দিনে নারীদের বেপর্দা অবস্থায় রাস্তাঘাটে বের হওয়া যাবে না। এ বিষয়ে কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন মূর্খতার যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)। নারীগণ পর্দা পালন করে বের হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, জাহান্নামবাসী দু’ধরনের লোক, যাদের আমি এখনো দেখতে পাইনি। একদল লোক যাদের সাথে গরুর লেজের ন্যায় চাবুক থাকবে, তা দিয়ে তারা লোকজনকে প্রহার করবে। আর এক দল এমন নারী যারা পোশাক পরিধান করেও উলঙ্গ মানুষের মতো হবে, অন্যদের আকর্ষণ করবে ও অন্যরাও তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে, তাদের মাথার চুলের অবস্থা উটের হেলে পড়া কুঁজের মতো। ওরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না; এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না, যদিও তার সুগন্ধি বহু দূর থেকে পাওয়া যায়। (সহীহ মুসলিম)।
গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা : ঈদ উপলক্ষে বিশেষ নাটক, সিনেমা ও বিভিন্ন গান বাজনাÑ যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমার উম্মতের মাঝে এমন একটা দল পাওয়া যাবে যারা ব্যভিচার, রেশমি পোশাক, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল (বৈধ) মনে করবে।’ (সহীহ বুখারী)।
বেহুদা কাজে সময় ব্যয় করা : অনেকে বেহুদা কাজে ঈদে রাত জাগরণ ও দিনে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে থাকে। সেজন্য বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা দরকার। আল কুরআনে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিমুখ থাকে।’ (সূরা মুমিনুন : ৩)।
ঈদের দিনে মহিলা-পুরুষের বেপরোয়া দেখা-সাক্ষাৎ : দেখা যায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এ গুনাহের কাজটা ঈদের দিনে বেশি করা হয়। নিকটাত্মীয়দের মাঝে যাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ শরিয়ত অনুমোদিত নয়, তাদের সাথে অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করা হয়। উকবাহ ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সা. বলেন, ‘তোমরা মহিলাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে।’ মদিনার আনসারদের মধ্য থেকে এক লোক প্রশ্ন করল হে আল্লাহর রাসূল! দেবর-ভাসুর প্রমুখ আত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? তিনি উত্তরে বললেন, ‘এ ধরনের আত্মীয়-স্বজন তো মৃত্যু।’ (সহীহ বুখারী)।
অপচয় ও অপব্যয় করা : ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষ্যে সব কিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা কোনোভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’ (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৬-২৭)। আরো বলা হয়েছে, ‘এবং তোমরা খাও, পান করো এবং অপচয় করো না।’ (সূরা আরাফ : ৩১)।
ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা : অনেকে এ দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করে থাকেন, যা রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে সাব্যস্ত হয়নি। অতএব ঈদের দিনকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এজন্য রাসূল স. বলেছেন, ‘যে এমন ইবাদাত করল যাতে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই, তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে।’ (সহীহ মুসলিম)।
জুয়া খেলা ও আতশবাজি করা : এগুলো শরিয়তবিরোধী কাজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা মায়িদা : ৯০)।
মানুষকে কষ্ট দেয়া : ঈদের দিনে অনেকে এমন কাজ করেন, যা মানুষকে কষ্ট দেয়। যেমন, রাস্তা আঁকিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া, এমন আনন্দ করা যাতে অন্যরা কষ্ট পায়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘মুসলিম ঐ ব্যক্তি যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্যরা নিরাপদ।’ (সহীহ বুখারী : ৬৪৮৪)
ঈদের সালাত আদায় না করে কেবল আনন্দ-ফুর্তি করা : অনেকে ঈদের আনন্দে মাতওয়ারা হয়ে নতুন জামা-কাপড় পরিধান, সেমাই, ফিরনী ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, ঈদের সালাত আদায় করার কথা ভুলে যান। অথচ এই দিনে ঈদের সালাত আদায় করা হচ্ছে মূল করণীয়।
উপসংহার: ঈদ একটি ইবাদত। আনন্দ ও ফুর্তি করার মাধ্যমেও যে ইবাদত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ। শরিয়াহ সম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়ে কুরআনে এসেছে, ‘বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’ (সূরা ইউনুস : ৫৮)।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ এবং শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে আমরা ঈদ উদযাপন করবো, ইনশাআল্লাহ। এ বিষয়ে আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’ (সূরা আল বাকারা : ১৮)।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদ, টাঙ্গাইল জেলা।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …