॥ প্রফেসর ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ ॥
কুরবানি শব্দটি মুখে মুখে প্রচলিত। কার্যক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানে এটি প্রযোজ্য। যুগে যুগে কুরবানির নজির বিদ্যমান। যারা নিজেকে কুরবান বা আত্মলীন করতে পেরেছেন, তারাই সফলকামী। তারাই সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন। হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকেই কুরবানির ইতিহাস বিদ্যমান। হজরত আদম আ.-এর পুত্র হাবিল থেকে শুরু করে সব আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম সকলেই নিজেকে আল্লাহর রাহে কুরবানি করেছেন। রাসূলে কারীম সা.-এর সময়ে সাহাবা কেরামের কুরবানি করার ইতিহাস আমাদের সামনে উজ্জ¦ল। ইসলামের সকল ইবাদতের মতো ঈদও আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্দেশিত। কুরবানি কুরআন-সুন্নাহতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিধান এবং আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ থেকে নির্দেশিত অন্যতম প্রধান ইবাদত। ১০ জিলহজ আল্লাহর ব্যাপক মাগফিরাত লাভের আনন্দ এবং ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল আনুগত্য-কুরবানি পেশ করার আনন্দ। ঈদুল আজহা সম্পর্কে সুনানে আবু দাউদ; সুনানে নাসাঈ শরিফে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আমাকে কুরবানির দিবসে ঈদ উদযাপনের আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তা এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন।’ এক সাহাবী আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমার কাছে শুধু একটি ‘মানীহা’ থাকে (অর্থাৎ যা আমাকে শুধু দুধ পানের জন্য দেয়া হয়েছে) আমি কি তা কুরবানি করতে পারি? নবী সা. বললেন, ‘না, তবে তুমি চুল, নখ ও গোঁফ কাটবে এবং নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানি বলে গণ্য হবে। (জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার পর ১০ দিন না কেটে ঈদের দিন কাটার কথা বলা হয়েছে)।
তাফসীরে ইবনে কাসীরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর একটি রেওয়ায়েতে উত্তমসূত্রে কুরবানির প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। হজরত আদম আ.-এর দুজন ছেলে ছিল। হাবিল আর কাবিল। হজরত হাওয়া আ. প্রত্যেকবার এক জোড়া সন্তান প্রসব করতেন। একটি ছেলে অপরটি মেয়ে। এই যমজ ভাই-বোনদের বিয়ে ছিল হারাম। তাই তখন একগর্ভে জন্মলাভ করা ছেলের সাথে ভিন্নগর্ভে জন্মলাভ করা মেয়ের বিয়ের নিয়মই প্রচলিত ছিল। কাবিলের যমজ বোনটি ছিল বেশি সুন্দর চেহারার অধিকারিণী। যমজ হওয়ার কারণে তাকে কাবিল বিয়ে করার নিয়ম না থাকলেও তার জেদ ও হঠকারিতা ছিল যে, সে তাকে বিয়ে করবেই। অন্যদিকে হকদার হওয়ার দাবি ছিল হাবিলের। এ দ্বন্দ্বের ফয়সালা হলো এভাবেÑ প্রত্যেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে কিছু কুরবানি করবে। যার কুরবানি কবুল হবে তার দাবিই গ্রহণযোগ্য হবে। হাবিল একটি দুম্বা ও কাবিল কিছু ফলফলাদির কুরবানি পেশ করল। তখনকার দিনে কুরবানি কবুল হওয়ার আলামত ছিল, আকাশ থেকে আগুন নেমে কবুলকৃত কুরবানি খেয়ে ফেলত। যথারীতি আগুন এসে হাবিলের দুম্বাটি খেয়ে ফেললো, কাবিলের কুরবানি জমিনেই রয়ে গেল।
মূলত কুরবানি অন্তরের বিশুদ্ধতার বিষয়, লোকদেখানো কোনো বিষয় নয়। হাবিল মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কুরবানি করেছিলো বলে তা কবুল হয়েছিলো। কুরবানিদাতা শুধুমাত্র পশুর গলায় ছুরি চালায় না; বরং সে তার সকল কুপ্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালিয়ে তাকে নির্মূল করে। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানি করা হয়, তা হজরত ইবরাহীম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর কুরবানির মতো হবে না; তা হবে শুধু গোশত খাওয়া। ইখলাসের সাথে কুরবানি করতে হবে। মহব্বতের সাথে কুরবানি দিতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে সম্মান রক্ষা কিংবা লোকদেখানো কুরবানির রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে। অথচ সূরা হজের ৩৭নং আয়াতে মহান আল্লাহর ঘোষণা, আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না এর গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।
ঈদুল আজহা বাংলাদেশে কুরবানির ঈদ নামেই সমধিক পরিচিত। একে বকরি ঈদও বলা হয়। আরবী কুরবান শব্দটির অর্থও নৈকট্য। অন্যদিকে ঈদুল আজহার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জবেহের আনন্দ-উৎসব। যে উৎসবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কুরবানি দেয়া হয় এবং যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয় সেটাই কুরবানির ঈদ। কুরবানির ঈদ বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বিপ্লবাত্মক প্রভাব ফেলে আসছে। ঈদুল আজহা এমন এক আনন্দ-উৎসব, যা শুধু জীবনকে জানা এবং উপলব্ধি করার প্রেরণাই দান করে না, বরং আল্লাহর সঙ্গে বান্দার নৈকট্য লাভের পথও প্রশস্ত করে দেয়। এ উৎসব আমাদের সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুপ্রেরণা। কুরবানির পশুর গোশ্ত তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া এবং আর এক ভাগ নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য রাখা- এ বণ্টননীতি ঈদের আনন্দ সবাইকে সমানভাগে ভাগ করে নেয়ার প্রেরণায় উদ্ভাসিত করে।
ঈদুল আজহা আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করে এবং আত্মসচেতনতায় বলীয়ান করে। এ দিনে সামর্থ্যমতো ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ পরে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে ঈদগাহে গিয়ে বড় জামাতে দুই রাকাত নামাজ ইমামের পেছনে আদায় করার মধ্যে আলাদা এক আন্তরিক তৃপ্তি পাওয়া যায়। নামাজ শেষে ধনী-গরিব একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি, পশু কুরবানি, কুরবানির গোশ্ত ধনী-গরিবের মাঝে বণ্টনের মধ্যে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য ফুটে ওঠে, তা বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এক মিলনমোহনায় এসে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায়।
একসময় কুরবানির ঈদকে গ্রামে-গঞ্জে বকরি ঈদ বা বকরা ঈদ বলা হতো। অবশ্য এখনো এ শব্দটি গ্রামাঞ্চলে বেশ প্রচলিত আছে। কিন্তু কেন এই নামটা ব্যবহার করা হতো, তা কি কখনো ভেবে দেখা হয়েছে? এ বিষয়টিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্রিটিশপূর্ব বাংলায় কুরবানির ঈদে যথারীতি গরু-ছাগল কুরবানির নিয়ম থাকলেও বাংলার মুসলমানদের জন্য ব্রিটিশ আমলের প্রায় দেড়শো বছর গরু কুরবানি দেয়া অনেকাংশে অসম্ভব ছিল। বিশেষ করে হিন্দু জমিদারদের অঞ্চলে গরু কুরবানি কল্পনাও করা যেত না। কেউ কুরবানি দেয়ার নিয়ত করলে সর্বোচ্চ খাসি, ছাগল বা বকরি দেয়া যেত। আরবী বাকারা শব্দের অর্থ গাভি বা গরু। এ বাকারা শব্দটি বকরিতে রূপান্তর করে ছাগল কুরবানি দিলেই কুরবানির হক আদায় হবে বলে ধরে নেয়া হতো। যেহেতু গরু কুরবানি দেওয়া সম্ভব নয়, কুরবানি দিতে হচ্ছে ছাগল, তাই বাকারা থেকে শব্দটি বকরিতে রূপান্তরিত করা হয়। এ ব্যাপারে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘বকরা ঈদে গরু কোরবানী কেউ করি তো না। জমিদারদের তরফ হইতে ইহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খালি বকরী কোরবানী চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর।’
ব্রিটিশ বিদায়ের মধ্য দিয়ে আবারো কুরবানির ক্ষেত্রে এক অভিনব বিপ্লব সাধিত হয়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে বাংলার ঘরে ঘরেও ফিরে আসে ঈদের আমেজ। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে কৃতিত্বের দাবিদার বাংলার ওলামা শ্রেণি। শহীদ তিতুমীর ও হাজী শরীয়তুল্লাহর পথ ধরে বাংলার মুসলমানদের ঈমান-আকিদা সংরক্ষণের প্রয়াসে তাদের গৃহীত কর্মসূচিসমূহ বিংশতাব্দীকেও প্রভাবিত করে। সেইসাথে সৈয়দ আমীর আলী এবং নবাব আবদুল লতিফের আধুনিক চিন্তা-চেতনা মুসলিম মানসে রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা তৈরিতে সক্ষম হয়। ১৯০৫ সালের বাংলা বিভক্তিকরণ এবং ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা বাংলার মুসলমানদের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বর্তমানে ঈদ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হতে চলেছে। ধনী-গরিবের মধ্যকার বিভেদও আগের চেয়ে অনেকাংশে কমেছে; বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষদের মন ও মননে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমভাবাপন্ন মানসিকতা তৈরি হতে চলেছে। এটা ভীষণভাবে আমাদের আশান্বিত করে। তবে মিডিয়ার কল্যাণে ঈদ উৎসবে যতটা মাতামাতি হচ্ছে, তার বৃহৎ অংশই ঈদের মূল তাৎপর্যকে ম্রিয়মাণ করে দিচ্ছে। নগ্নতা আর আধুনিকতার নামে জাহেলি কালচারের সাথে সবাই যেন খাপ খাওয়াতে ব্যস্ত। আগামী প্রজন্মের জন্য এটা হবে অত্যন্ত বড় রকমের অভিশাপ। তাই ঈদ উৎসবের মূল চেতনাকে ধারণ করেই এটাকে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করার জন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকর্মীগণকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে।
কুরবানির ঈদ নিয়েই আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা ছড়া, কবিতা, গান, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রভৃতি লিখেছেন। এসব লেখায় ত্যাগের মহিমার সঙ্গে যোগ হয়েছে বিপ্লবী চিন্তা ও আত্মদানের প্রসঙ্গ। পত্রপত্রিকার ঈদ-সংখ্যা একে আরো একটু গতি দেয়। ঈদের কবিতা-গান-কথাসাহিত্য আমাদের ধর্মীয় আনন্দের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জাগিয়ে তোলে। তবে ইদানীং ঈদ সংখ্যাগুলো খানিকটা ঈদবিবর্জিত সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়ে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ সাজার একটা সর্বনাশা প্রবণতা শুরু করেছে। এটা জাতির জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়।
আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। কিন্তু এদেশে কুরবানি উপলক্ষে ফ্রিজের বাজার সরগরম হয়ে ওঠে। এদেশে এমন বিচিত্র মানুষও আছেন, যারা কুরবানির পর আস্ত পশুটিই ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখেন আর সারা বছরের গোশতের প্রয়োজন পুষিয়ে নেন। এটা কোনোভাবেই মানবিক আচরণ হতে পারে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। একটি ইবাদত আদায় করতে গিয়ে পশুর বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা দ্বারা ঘরের আঙিনা ও পথ-ঘাটকে দূষিত করে তোলা মোটেই উচিত নয়। এতে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সবার সতর্কতা ও সচেতনতা একান্ত জরুরি।
লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Check Also
ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়
দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …