বাইডেন-মোদি বৈঠকে উঠলো না বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার স্বপ্নে যা আশা করেছিল, হোয়াইট হাউস তাই দিয়েছে। ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার পর মোদি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বহীন এক ব্যক্তি ছিলেন। ভারতের বর্তমান সরকারের হিন্দুত্ববাদ নীতির সাথেও বাইডেন প্রশাসনের নীতির অনেক পার্থক্য রয়েছে, বিশেষ করে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে তো সরাসরি বিরোধ রয়েছে। তা সত্ত্বেও মোদির আমেরিকা সফরে সেসব ভূমিকাকে অস্বীকার করেছে হোয়াইট হাউস। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের পতনের পর থেকে বিশ্ব এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের উত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই অঞ্চলে একটি শক্তিশালী মিত্র খোঁজা প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। ভারত কিছু ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের চাহিদা পূরণ করেছে। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মতো সংকটময় সময়ে ভারতকে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে দেখা গেছে।

ভারত তার প্রয়োজনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার তেল কিনেছে। সেই ইউএসএসআর-এর যুগ থেকে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র রয়েছে। রাশিয়া ও চীন দুই মহাযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিকল্প গঠনে ব্যস্ত। এদিকে ট্রাম্প যুগ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অসন্তুষ্ট ভারত, তবে ভারত অসুখী হলেও চীনের কথা মাথায় রেখে পারস্পরিক বোঝাপড়ার রাস্তা খোলা ছিলো।

বিজ্ঞাপন

তাই পশ্চিমা- বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করার বিরুদ্ধে চীনকে একটি বার্তা পাঠানোর জন্য ভারতকে পশ্চিমা জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে ওয়াশিংটনকে অনেক কিছু করতে হয়েছিল। এই কারণেই মোদিকে এমন রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল যা সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনও বিশ্ব নেতাকে দেয়নি।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে একটি বিশাল রাষ্ট্রীয় ভোজ এবং কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার মতো সম্মান দেওয়া হয়েছে । প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্ট লেডি হোয়াইট হাউসে একটি ব্যক্তিগত নৈশভোজে মোদির সাথে মিলিত হন । এখানেই শেষ নয় , ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং স্টেট সেক্রেটারি অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন। ৫৮-পৃষ্ঠার যৌথ বিবৃতিতে যদিও চীন এবং তার উত্থান নিয়ে উদ্বেগ হবার কোনো বিষয় প্রতিফলিত হয়নি । কারণ, ওয়াশিংটন ভারতকে তার দিকে নিয়ে আসা এবং একটি নরম শক্তি হিসাবে চীনের সাথে মোকাবিলা করার পন্থা বেছে নিয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে-গণতন্ত্রের মূল্যবোধ, মানবাধিকার, আইনের শাসন, বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধার মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলগুলিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের সাথে সংযুক্ত করার উপর ব্যাপকভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে ।

ওয়াশিংটন প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় ভারতকে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছে। ভারতের মাটিতেই GE F-414 জেট ইঞ্জিন তৈরি করার অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকা , এটি এমন একটি ছাড় যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ঐতিহ্যগত মিত্রদেরও দেয়নি। দুই নেতা এই সিদ্ধান্তকে একটি “ট্রেলব্লেজিং উদ্যোগ” বলে অভিহিত করেছেন যা আগের চেয়ে মার্কিন জেট ইঞ্জিন প্রযুক্তি ভারতে আরও বেশি স্থানান্তর করতে সক্ষম করবে। বিষয়টি চীনকে কতটা নাড়া দিতে পারে তা অনুমেয়। তা সত্ত্বেও, ওয়াশিংটন সামিট চীনকে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে না বলে মনে করেন বিজেপি নেতা ডঃ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। তিনি বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের নিটফল কার্যত “শূন্য”। স্বামী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কারণ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বৈঠকের টেবিলে ভারতের বিরুদ্ধে চীনা আগ্রাসনের প্রতিফলন করতে ব্যর্থ হন , যেখানে চীন ৪০২৫ বর্গ কিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে ।

স্বামী তাই ভারতীয়দের নরেন্দ্র মোদির প্রতি ওয়াশিংটনের এই রাজকীয় আচরণে প্রতারিত না হতে অনুরোধ করেছেন। নরেন্দ্র মোদির তথাকথিত ঐতিহাসিক সফরের উপসংহার টানতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ স্বামী একজায়গায় বলেছেন -”এটি মোদির মতো একজন বাঘ-কে বাগে আনার একটা কৌশল ছিলো মাত্র ”।যদিও যৌথ বিবৃতিতে পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে ভারতীয়রা খুশি হবে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনেছিল। এদিকে মোদির সফর নিয়ে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে অনেক প্রত্যাশা ছিল। তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে আওয়ামী লীগের প্রতি মনোভাব নরম করার জন্য হয়তো অনুরোধ করবেন। অতি-উৎসাহী কলকাতার সাংবাদিকরা এমনকি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদি নিজে থেকে টানা ৪ বারের মেয়াদের জন্য আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ টানবেন । কিন্তু শীর্ষ সম্মেলনে কোনোভাবেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠলো না !

বিষয়টি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অসন্তুষ্ট করেছে । যৌথ বিবৃতিতে , ভারত সর্বজনীনভাবে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অন্তর্ভুক্তি, বহুত্ববাদ এবং সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সমর্থন করতে সম্মত হয়েছে। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভারত আসলে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য ওয়াশিংটনের উদ্যোগকে সমর্থন করতে সম্মত হয়েছে। এই শীর্ষ সম্মেলনটি এমন কিছু কেড়ে নিয়েছে যা এই অঞ্চলে নয়া দিল্লি এবং অত্র প্রতিবেশীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমেরিকা ৯/১১ এর পরে ভারতকে তার পক্ষে দক্ষিণ এশিয়া দেখাশোনা করার জন্য অলিখিত ক্ষমতা দিয়েছিল। যার জন্য পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি নয়াদিল্লি মারফত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। শীর্ষ সম্মেলনে নীরবতার মাধ্যমে এই ক্ষমতা ভারতের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন না করে মোদি-বাইডেন শীর্ষ সম্মেলন বাংলাদেশকে আসলে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বহুত্ববাদ এবং সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ- এর ভিত্তিতে বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন যাতে সংঘটিত হয় ৩৬ নং অনুচ্ছেদ মারফত নয়াদিল্লিকে সেই প্রতিশ্রুতিতেই বেঁধেছে আমেরিকা ।

লেখক : জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।