২০১৩ সালের ডিসেম্বরে, সাধারণ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে । নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সরকার প্রত্যাখ্যান করায় বৃহত্তম বিরোধী দল, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি এবং তার সহযোগী জামায়াত-ই-ইসলামী বাংলাদেশ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় । এদিকে, জামায়াতের নেতা-কর্মীরা আ.লীগ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তাদের শীর্ষ নেতাদের বিচারের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। গোটা বিষয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায়ের কাছে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলো সে সময়। বিক্ষোভে পুলিশের ভূমিকা ছিল অত্যাধিক সহিংস, এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার সবচেয়ে মারাত্মক বছরের মধ্যে একটি ছিলো ২০১৩ সাল , যেখানে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে। বিরোধী দল বর্জন করলেও আ.লীগ তার নিজস্ব প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলো । আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রধান বিরোধী দলগুলির দ্বারা বয়কট করা একটি নির্বাচন মেনে নিতে অস্বীকার করে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন চায়।
ওই বছরের ডিসেম্বরে, তৎকালীন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। সিংয়ের সফর তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সিংয়ের সাথে বৈঠকের পর, বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ তার অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং নির্বাচনে অংশ নেন।
বিজ্ঞাপন
সুজাতা সিং তার সফরের সময় সাংবাদিকদের কাছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেন। তার প্রথম বার্তাটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের জন্য ভারতের প্রবল আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে । সিং পরামর্শ দিয়েছিলেন যে যদি জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় আসার ঝুঁকি থাকে। তার দ্বিতীয় বার্তা ছিল ভারত বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চায়।স্থানীয়ভাবে এই বার্তাটিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে ভারত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শাসনের ধারাবাহিকতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বিশ্বাসযোগ্য বিরোধী প্রতিযোগীর অভাব এবং কম ভোটারের উপস্থিতি সত্ত্বেও, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ভারত, রাশিয়া ও চীন হাসিনার সরকারকে সমর্থন করে ।
ভারত ছাড়া , প্রধান গণতান্ত্রিক দেশগুলি এখন পুনরায় নির্বাচনের আহ্বান জানাচ্ছে। ভারতীয় সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার মন্তব্য করেছেন, ”ভারত কৌশলগতভাবে খুব কাছের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে পক্ষপাতমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে না।”
২০১৮ সালে, শেখ হাসিনা আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, যেখানে বিরোধীরা অংশগ্রহণ করেছিল। নির্বাচনের আগে ব্যাপক ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং বিরোধী দলের কর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল । সেই বিতর্কিত নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ছিলেন বেনজির আহমেদ, যিনি হাসিনার অধীনে পুরস্কারস্বরূপ একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ পদ আসিন হয়েছিলেন এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
অতীতের এই প্রহসনমূলক নির্বাচনে হাসিনাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে ভারত রাজনৈতিক পরিমণ্ডল এবং জনসাধারণের কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। যাইহোক, হাসিনা এই সুযোগটি দক্ষতার সাথে কাজে লাগান বাংলাদেশে চীনা প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে এবং ভারত ও পশ্চিমাদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি বার্তা পাঠানোর লক্ষ্যে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ আবারও একই রকম রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে ,যখন দেশটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাসিনা তার সিদ্ধান্তে নির্বাচন পরিচালনায় অবিচল রয়েছেন, অন্যদিকে বিরোধীরা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করছে। বিরোধী দলওগুলিও একটি গণ-অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও এবার আওয়ামী লীগ পূর্ববর্তী দুটি নির্বাচনের মতো নৃশংস বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিরোধীদের দমন করার বিষয়ে নিশ্চিত নয়।
আসলে অনেক রাষ্ট্রীয় এজেন্ট আসন্ন নির্বাচনে কারচুপির বিষয়ে সতর্ক রয়েছে কারণ তারা আশঙ্কা করছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। কানাডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের অবসর যাপনের জন্য পছন্দের জায়গা এবং তারা তাদের সন্তানদের পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে “গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া” ক্ষুণ্ন করে এমন বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যা ব) এবং এর ছয়জন সিনিয়র কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টও দুই কর্মকর্তার উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যাদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যেই ট্রেজারি বিভাগের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছেন। এই সিদ্ধান্তগুলি মানবাধিকার কর্মী এবং বিরোধী দলগুলির কাছ থেকে জোরালো সমর্থন পেয়েছে।
মার্কিন চাপের জবাবে হাসিনা প্রকাশ্যে দাবি করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সরকারের পতন চাইছে।তিনি একটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের জন্য তার কুর্সি হারাতে রাজি নন।গত এক দশকে, তার সরকার এমন কোনো নির্বাচন আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়েছে যা তার দল বা প্রশাসনের বাইরের লোকেরা অবাধ ও সুষ্ঠু বলে মনে করে। বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে তার নিজের প্রশাসনের অধীনে আরেকটি নির্বাচন করার চেষ্টা করলে যুক্তরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় থাকবে না। অন্যদিকে সবধরনের অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাসিনার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে।
বিপরীতে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিয়ে ভারত এবার একটু পিছিয়ে থাকতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে।বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশন এবং ভারতীয় হাইকমিশনার পূর্ববর্তী নির্বাচনী সময়ের তুলনায় তাদের কার্যক্রম সীমিত করেছে। একসময়ে তারাই সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল এবং সংবাদমাধ্যমের সাথে বেশি সম্পৃক্ত ছিল। পূর্বে ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করতেন । সেই দৃশ্যপট বর্তমানে অনেকটাই বদলে গেছে । ভারতের সরকারী দৃষ্টিভঙ্গির এই নীরব পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা এবং বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। বিপরীতে, মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘন ঘন বাংলাদেশে সফর করছেন এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক ঝুঁকি বিশ্লেষণকারী সংস্থাগুলি, যেমন ‘কন্ট্রোল রিস্ক’ বিনিয়োগকারীদের হাসিনা-পরবর্তী সরকারের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।
এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যখন এগোবে তখন দেশটির ভবিষ্যৎ গঠনে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ভূমিকা থাকবে। আসন্ন নির্বাচনের প্রকৃতি শুধু রাজনৈতিক দৃশ্যপটই নির্ধারণ করবে না, দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে।
সূত্র : দ্য ডিপ্লোম্যাট
লেখক : সিডনিভিত্তিক পণ্ডিত এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির বিশ্লেষক।