আবু সাইদ বিশ্বাস, ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরাঃ চরম দুরবস্থায় পড়েছে সাতক্ষীরাসহ সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলের জেলেরা। ৬৫ দিনের চলমান নিষেধাজ্ঞায় আর্থিক দুরবস্থায় পড়েছেন সুন্দরবনের নদনদীসহ সাগরকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করা দেড় লাখেরও বেশি জেলে। এর বাইরে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তঅনুযায়ী ১ জুন থেকে ৯২ দিনের জন্য সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশে আরেকটি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে বন বিভাগ। সব মিলিয়ে ১০৪ দিনের জন্য সুন্দরবনে ঢুকে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে পারবেন না জেলেরা। এর ফলে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের ওপর নির্ভরশীল দেড় লক্ষাধিক জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি পর্যটক বহনকারী ট্রলার চালানোর সঙ্গে জড়িত পাঁচ শতাধিক শ্রমিক পরিবারও বিপাকে পড়েছে। সরকারি হিসাব মতে ১২ হাজার ৮৭৯ জন জেলেকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। তবে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা দলীয়করণের মাধ্যমে তালিকা করে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সরকারি সহযোগিতা দেয়ার ব্যবস্থা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
শ্যামনগর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে সাতক্ষীরা রেঞ্জের শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩১ হাজার ৪৫৫ জন। এর মধ্যে যাদের সাগর-সুন্দরবনের নদনদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরা ছাড়া অন্য কোনো পেশা নেই এমন ১২ হাজার ৮৭৯ জনকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। তবে যারা সাগরে মাছ ধরেন না, শুধু সুন্দরবনের নদনদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। এ হিসাবে সাতক্ষীরা রেঞ্জের ১৮ হাজার ৫৭৬ জন নিবন্ধিত জেলে নিষেধাজ্ঞার ১০৪ দিন সুন্দরবনে মাছ ধরতে পারবেন না। এমনকি কোনো সহায়তাও পাবেন না তারা। এর বাইরে আরও কয়েক হাজার অনিবন্ধিত জেলে রয়েছেন যারা সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবী বাওয়ালি ও মৌয়াল। দীর্ঘ ৩ মাস বেকারত্বের মধ্যে কাটাবেন তারা। ফলে পরিবারগুলো পড়েছেন মানবেতর জীবনযাপনের শঙ্কায়। জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতি শ্যামনগর শাখার সভাপতি জি এম মনসুর আলম অভিযোগ তুলে জানান, প্রকৃত জেলেদের মাঝে সরকারি সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে না। ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা দলীয়করণের মাধ্যমে তালিকা করে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী সরকারি সহযোগিতা দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। তাদের কাছে বারবার অনুরোধ করার পরও আমলে নিচ্ছেন না।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, শ্যামনগর উপজেলায় ২৩ হাজার ৪৫৩ জন, আশাশুনি উপজেলায় ৮ হাজার দুজন, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৩ হাজার ৭১ জন ও তালা উপজেলায় ৩ হাজার ৮২১ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। সাগরে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত এসব জেলের মধ্যে শ্যামনগর উপজেলার ৮ হাজার ৩২৪ জন ও আশাশুনি উপজেলার ৪ হাজার ৫৫৫ জনকে গত ২০ মে থেকে আগামী ২৩ জুলাই এ ৬৫ দিনের জন্য মাথাপিছু ৮৬ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সুন্দরবন জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল সমিতির সভাপতি সুশান্তমন্ডল বলেন, সাতক্ষীরা রেঞ্জে দেড় লাখেরও বেশি জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। ১০৪ দিন তারা সুন্দরবনে ঢুকতে পারবে না। এর মধ্যে মাত্র শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ১২ হাজার ৮৭৯ জনকে ৮৬ কেজি করে চাল দেয়া হবে। তাহলে অন্যরা এ সময় কীভাবে চলবেন, তা কেউই জানে না। জুন থেকে আগস্ট এই ৩ মাস প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশিরভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে ১ জুন থেকে ৯২ দিনের জন্য জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশের সব ধরনের অনুমতি বন্ধ রাখে বন বিভাগ। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্তএই নিষেধাজ্ঞা আরোপ থাকবে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্তসব নদী ও খালে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হচ্ছে। সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার, যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া আছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন বন বিভাগের আওতাধীন খুলনা সাতক্ষীরা রেঞ্জে মোট ১২ হাজার নৌকার সুন্দরবনে প্রবেশের বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) আছে। সে হিসেবে প্রতিটি রেঞ্জে মোট ৩ হাজার বিএলসি নৌকা আছে।
সুন্দরবনের কালাবগি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল হাকিম বলেন, ‘৩ মাস সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো, মাছের প্রজনন বৃদ্ধি করা। ফলে, সুন্দরবনের সব পর্যটন কেন্দ্রে দর্শনার্থীদের যাতায়াতও বন্ধ থাকবে।’খুলনা বিভাগীয়বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি এই ৯০ দিন প্রান্তিক জেলে বাওয়ালিদের বিকল্প খাদ্য সহায়তা দেওয়ার। বিকল্প খাদ্য ও সহায়তার জন্য জেলে বাওয়ালির প্রতি পরিবারকে মাসের ৪০ কেজি চাল দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। এটা প্রক্রিয়াধীন আছে। ‘জুন-জুলাই-আগস্ট ৩ মাস সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম। তাই এই সময়ে কাউকে বনে প্রবেশ করতে দেব না। শুধু মাছ শিকারই বন্ধ নয়, নির্দিষ্ট এ সময়ে বনের অভ্যন্তরে ও অভয়ারণ্যে পর্যটক প্রবেশও নিষেধ,’ বলেন তিনি। এদিকে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ঈদে সুন্দরবন ভ্রমণে করতে পারেনি পর্যটকরা। নদী ও সাগরে মাছের প্রজনন বৃদ্ধির মৌসুম চলায় তিন মাস সব ধরনের নৌযান চলাচল ও পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা চলছে। এ কারণে এবার ঈদে সুন্দরবন ভ্রমণ করতে পারছেন না পর্যটকরা। পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন ব্যবসায় জড়িতরা।
সুন্দরবনের ট্যুর ব্যবসায়ী রাসেল বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে টানা সাত মাস বন্ধ থাকার পর ২০২০ সালের ১ নভেম্বর থেকে পর্যটকদের জন্য সুন্দরবন খুলে দেয়া হয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিন পর প্রাণচাঞ্চল্য ফেরে সুন্দরবন কেন্দ্রিক সব পর্যটন শিল্পে। সে সময়ে একটু বিনোদনের জন্য অনেকেই সুন্দরবনে বেড়াতে আসেন। গত ২০২১ ও ২২ সালের জুন থেকে আগস্ট টানা তিন মাস করে পর্যটন মৌসুমে সুন্দরবন ভ্রমণ বন্ধ ছিল। কিন্তু আবারও সুন্দরবনে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আসায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। ঈদের ছুটিতে পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণে আসতেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে তা বন্ধ রয়েছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) বেলায়েত হোসেন বলেন, মাছের প্রজনন বৃদ্ধির বৃহত্তর স্বার্থে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণ করতে পারবেন। বন কর্মকর্তা আরো বলেন, সুন্দরবনে পুরনো পর্যটন স্পটগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন এবং নতুন আরও চারটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট নির্মাণ করা হচ্ছে। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এই পর্যটন স্পটগুলো হচ্ছে সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগে শেখেরটেক,
শরণখোলার আলীবান্ধা, কালাবাড়ি ও কৈলাশগঞ্জ পর্যটন কেন্দ্র। এই পর্যটন স্পটগুলো নির্মিত হলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ আরও বাড়বে।