উপকূলীয় অঞ্চলে ঝুঁকিপূণ পাট চাষ,দরকার কার্যকরী পরিকল্পনা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ উপকূলীয় অঞ্চলে পাট চাষ ঝুঁকিপূণ হয়ে উঠেছে। দিন দিন লবণাক্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিক তাপমাত্রা, কড়া রোদ্রোজ্জ¦ল আবহাওয়া ও অনাবৃষ্টিজনিত শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করার ফলে মাটিতে থাকা পানি অধিক হারে বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জমিতে সাগরের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের ফলে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ততাজনিত কারণে পাট বীজের অংকুরোদগম মারাত্মকভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হয়। এসব কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে পাট চাষ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৮ জেলায় পরিকল্পিতভাবে কৃষি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনের চিত্র বদলে যাবে। এরই মধ্যে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে লবণাক্তসহিষ্ণু পাটের চাষ কৃষকদের মাঝে আগ্রহ থাকলেও প্রচারণার অভাবে তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে না। সূত্রমতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৮ জেলায় মোট কৃষি জমির পরিমাণ ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৩০ শতাংশ। চাষযোগ্য এই জমির মধ্যে ১০ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিই বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। প্রতি বছর খরিফ-১ মৌসুমে এই বিশাল পরিমাণ জমি পতিত পড়ে থাকে। এই পতিত জমিতেই গত তিন বছর ধরে বিজেআরআই উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু দেশি পাট-৮ চাষে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে কৃষকরা।

সূত্রমতে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ । তবে পাট রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সবার শীর্ষে। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭.৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে ১৫.০২ লাখ টন পাট আঁশ উৎপাদিত হয় সেখানে ভারতে উৎপাদিত হয় ৬.৪০ লাখ হেক্টর জমিতে ১৭.৩৫ লাখ টন পাট। তাই পাট উৎপাদনে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় হলেও পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনও প্রথম স্থান দখল করে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ সচেতনতার কারণে মানুষের মাঝে পরিবেশবান্ধব পাট পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, বিশ্ব বাজারে পাট পণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরুকরেছে। ফলশ্রুতিতে পাটের মূল্যও বেশ বেড়ে গেছে। কিন্তু কৃষকরা বলছে তারা পাটের ন্যার্য মূল্য পাচ্ছে না। চাষিরা বলছে, লবণাক্ত জমিতে পাট ফসল চাষের একটি প্রধান সমস্যা। প্রতিবছর পাট বপন মৌসুমে জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া। এ সময় স্থানীয় নদ-নদী ও খালের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ে। তাদের দাবী স্থানীয়ভাবে খাল খনন/বিদ্যমান খাল সংস্কার করে এসব খালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ করলে বীজের অংকুরোদগম ভালো হবে এবং পাটের ফলন বৃদ্ধি পাবে। চাষীরা মনে করছে, এখন আর এক ফসলের পর তাদের লবণাক্ত জমি পতিত থাকবে না। এখন থেকে তারা পাট এবং আমন দুটি ফসলই আবাদ করতে পারবে।
বিশেজ্ঞরা বলছে, লবণসহিষ্ণু দেশি পাট-৮ এখন উপকূলীয় অঞ্চলের চাষীদের নতুন স্বপ্ন দেখাতে পারে। এক ফসলী জমিতে এখন দুটি ফসল আবাদ করতে পারবে চাষিরা। ফলে পাট চাষে উপকূলের গুরুত্ব বাড়বে কয়েক গুণ। সরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আয়তন এ দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০% এবং এ অঞ্চলে দেশের প্রায় ৩০% আবাদযোগ্য জমি রয়েছে যার পরিমাণ প্রায় ২৬.৫০ লাখ হেক্টর। উপকূলীয় অঞ্চলে মোট লবণাক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ১০.৬০ লাখ হেক্টর। এ পরিস্থিতিতে লবণাক্ততা সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনায় রেখে উপকূলীয় অঞ্চলে পাট চাষ সম্প্রসারণের জন্য বিশেষ কিছু কৌশল অনুসরণ করলে লবণাক্ত অঞ্চলে একদিকে যেমন পাট চাষ সম্প্রসারিত হবে তেমনি ওই অঞ্চলের শস্যনিবিড়তাও বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
গবেষণার রির্পোটে বলছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি জেলার ৬টি উপজেলায় পাটের আঁশ ও বীজ ফসল উৎপাদনের উপর একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে বলা হয় বিভিন্ন এলাকায় পাটের বীজ বপনের সময় পরিবর্তন করে জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার পূর্বেই শুষ্ক মৌসুমে স্বাদু পানি দ্বারা সেচ দিয়ে জমি তৈরি করে যদি বীজ বপন করা যায় তবে বীজের অংকুরোদগম স্বাভাবিক লবণাক্ততা অবস্থার তুলনায় প্রায় ২০% বৃদ্ধি পায় এবং তুলনামূলকভাবে পাটের ভালো ফলন পাওয়া যায়। কারণ দেরিতে বীজ বপন করলে পাট ফসল অধিক মাত্রার লবণাক্ততার ঝুঁকিতে পড়ে ও বীজের অংকুরোদগম মারাত্মকভাবে ক্ষতি” গ্রস্থ হয়। এর ফলে পাটের ফলন প্রায় ৫০% কমে যায়। বাংলাদেশে ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে ৯ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়ে ছিল। বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে পাটের আবাদের পরিমাণ ৭ লাখ ২১ হাজার হেক্টর জমিতে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, পাট একটি লাভজনক ফসল। নতুন জাতের লবণসহিষ্ণু দেশি পাট-৮ চাষের মধ্য দিয়ে উপকূলের অর্থনীতিতে পাট খাতে একটি বিপ্লব সাধিত হচ্ছে এবং কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশ আরও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমিতে অধিক সংখ্যক প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, কৃষক প্রশিক্ষণ ও মাঠ দিবস আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে লবণাক্তসহিষ্ণু পাটের চাষাবাদ প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলতে কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।