ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে উপকূলের খাদ্য নিরাপত্তা মানুষের জীবন ও জীবিকায় বিপর্যয়ের আশঙ্কাঃ বিপন্ন হতে পারে উপকূলীয় অঞ্চল

আবু সাইদ বিশ্বাস, ক্রাইমবাতা রিপোট:বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে উপকূলের খাদ্য নিরাপত্তা। জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হচ্ছে এবং ভূমি, বনাঞ্চল, শিল্প, বাসস্থান, পশু সমস্যা প্রকট হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। বিশেষ করে খাদ্য নিরাপত্তা চালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুমন্ডলে পুঞ্জীভূত গ্রিনহাউস গ্যাস উৎসারণের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য ও কৃষি কাজে। বীজ গজানো, পরাগায়ন ও পরিপক্ব হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোকের উপাদানগুলো পরিবর্ধিত হচ্ছে, কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষি মৌসুমের সঙ্গে ফসলের চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। এই অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে স্থানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করার দাবী জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞানীরা আশাঙ্কা করছেন আগামী ৫০ বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ ১ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় এলাকা তলিয়ে যাবে। উপকূলীয় ১৩ জেলার ৬৩ উপজেলার ৫৬ লাখ ৩৭ হাজার ৮৭৬ একর জমি তলিয়ে যাবে। যা দেশের মোট জমির ১৫.৮ ভাগ। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে আংশিক তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। এতে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হবে। মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে আসবে বিপর্যয়। বিপন্ন হবে উপকূলীয় অঞ্চল। সবুজ বন, নদী, নালা ও জলপ্রপাত তাদের নৈসর্গিক সৌন্দর্য হারাবে।
খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন একুশ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের জনসংখ্যা ২০৫০ সাল নাগাদ ৯ বিলিয়নে পৌঁছাবে এবং খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা ৮৫% বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে খরা, ভারি বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার তারতম্য, লবণাক্ততা এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণের কারণে কৃষি খাত হুমকির সম্মুখীন। প্রতি ডিগ্রি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বজুড়ে প্রধান খাদ্যশস্য যেমন- গম, চাল, ভুট্টা এবং সয়াবিনের উৎপাদন যথাক্রমে ৬.০% ৩.২%, ৭.৪% এবং ৩.১% হ্রাসের পূর্বাভাসও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লবণাক্ততাজনিত সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে এই সমস্যা আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন উপকূলীয় কৃষি জমিতে মৃত্তিকা লবণাক্ততা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য। উল্লেখ্য, সমুদপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিগত ২৫ বছরে উপকূলে লবণাক্ততা ১ থেকে ৩৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। লবণাক্ত পানি দিয়ে সেচ, কম বৃষ্টিপাত এবং উচ্চ বাষ্পীভবনের কারণে কৃষি জমিতে বার্ষিক ১০% হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই হারে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০% এরও বেশি আবাদি জমি লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। লবণাক্ত জমিতে আবাদ সম্প্রসারণ বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে হিমালয়ের বরফ, উত্তর মেরুও অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলতে শুরু করেছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। গত ১০০ বছরে সমুদপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে ১৫ সেমি. থেকে ২৫ সেমি.। বছরে বৃদ্ধির হার ১.৫ সেমি. থেকে ২.৫ সেমি.। যা গত ৩০০ বছরের ১০ গুণ। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে আগামী শতকে সমুদ্রের উচ্চতা বছরে বৃদ্ধি পাবে ৩০ সেমি. থেকে ৪০ সেমি.। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস করেন উপকূল অঞ্চলে, যাদের জীবিকার প্রধান উপাদান কৃষি। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে এ ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। সমুদ্রপৃষ্টে উচ্চতা বৃদ্ধি, উজানে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অনিয়িন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ারের মাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় পোল্ডারগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মূলত বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে। বর্তমানে ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৫৩ উপজেলায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের বাস। যার মধ্যে ১০ থেকে ৩৫ শতাংশ মানুষ অতি দরিদ্র।

সাতক্ষীরা অঞ্চলে ষাটের দশকে ওয়াপদার বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে গোটা এলাকায় কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। সবুজ গাছপালায় উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় মিনি অরণ্যে। ওই সময় প্রতিটি বাড়িতে ছিল গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান। এলাকার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। একপর্যায়ে আশির দশকে এ অঞ্চলে শুরু হয় পরিবেশ বিধ্বংসী লবণ পানির চিংড়ি চাষ। বর্তমানে শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটা, আশাশুনি, সদর ও তালা উপজেলায় প্রায় অর্ধলক্ষাধিক হেক্টর জমিতে সাদা সোনা খ্যাত লবণাক্ত পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। ফলে গত দুই দশক ধরে ধরে এ অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে

সংশ্লিষ্টরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার সংকট দূর করতে উপযোগি প্রযুক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিপর্যয় মোকাবেলায় প্রয়াজন সুদূরপ্রসারি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ।

Check Also

সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।