আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ বাংলাদেশের ফুসফুস নামে খ্যাত সুন্দরবন। পৃথিবীর অন্যতম জীব বৈচিত্রের আঁতুড়ঘর ও এই সুন্দরবন। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকা কে রক্ষা করে চলেছে, তেমনি জলবায়ুগত ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই বনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো ম্যানগ্রোভ। ম্যানগ্রোভ বলতে সমুদ্র উপকূলে জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত বিস্তীর্ণ জলাভূমিকে বোঝায়। ম্যানগ্রোভ বন জোয়ার-ভাটায় বিধৌত লবণাক্ত সমতলভূমি। নাসার স্যাটেলাইট ডাটার তথ্যমতে, ম্যানগ্রোভ বনকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কার্বন পরিশোধক। এরা বায়ুমন্ডল থেকে দীর্ঘমেয়াদে কার্বন ডাই অক্সাইড সরিয়ে ফেলতে পারে। এরা লবণাক্ত পরিবেশে কম অক্সিজেনেই বেঁচে থাকতে পারে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, পৃথিবীর ১৭% কার্বন নিঃসরণের ক্ষতি কমিয়ে দিতে সাহায্য করছে ম্যানগ্রোভ বন। পৃথিবীর ১১৮টি দেশে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে ম্যানগ্রোভ বন আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মোহনায় গড়ে ওঠা সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী জেলার ৬ লাখ ১,৭০০ হেক্টরজুড়ে সুন্দরবন অবস্থিত , যা দেশের ৪.১৩% । ৫৬ টি ব-দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই অসাধারণ বনাঞ্চল ৪২৬৪ বর্গ কিমি জুড়ে এর বিস্তারণ। ম্যানগ্রোভ বন জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করে।
ম্যানগ্রোভ দেহকোষ গহ্বরে লবণ সংগ্রহ করে রাখে। সমুদ্রের উচ্চ ঢেউ যখন লবণাক্ত পানি বয়ে আনে তখন ম্যানগ্রোভ বন এই পানি আসা প্রতিহত করে এবং যতটুকু পানি থেকে যায় শ্বাসমূল তা পরিশোধন করে। যে কারণে প্রতি বছর ২৬ জুলাই আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে । ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং এর প্রতিবেশ সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে এ বছরও দিবসটি পালিত হচ্ছে। ইকুয়েডরে ম্যানগ্রোভ কেটে চিংড়ি চাষ করার প্রতিবাদে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুলাই আয়োজিত সমাবেশে একজন অংশগ্রহণকারীর মৃত্যু হয়। সেই থেকে তাঁর স্মরণে এ দিনটিকে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এক তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে ১৯৮০ সাল থেকে ২০০৫ এই ২৫ বছরে ম্যানগ্রোভ বন ১৮৮,০০০ বর্গ কি.মি. থেকে ১৫২,০০০ বর্গ কি.মি. হয়েছে। বাংলাদেশে গত ২৫ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১০,৯৮০ হেক্টর। এছাড়া সুন্দরবনের আশপাশের স্থাপনা, কারখানা ও বনের মধ্য দিয়ে ডিজেল পেট্রোলচালিত নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ সুন্দরবনের অস্তিত্ব ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে । এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মোটামুটি ৬৬২ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড আটকে আছে! এর সঙ্গে প্রতিবছর আরো ৩৮ লাখ টন যোগ হচ্ছে। আটকে থাকা এই বিষ-গ্যাসের একাংশ শর্করায় পরিণত হওয়ায় প্রতিবছর এরা আরো গ্যাস আটকে রাখতে সক্ষম হয়।
বিশেজ্ঞরা বলছে, বাংলাদেশে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল কমে যাওয়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে লবণাক্ততার হার। যার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের চার কোটি লোক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে দৈনিক ৫ গ্রাম লবণ খেতে বলে, বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ সেখানে ২০ গুণ বেশি লবণ খায়। পানির লবণাক্ততা মাটির জৈব পদার্থ, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড,ফসফরাসের পরিমাণ কমিয়ে কপার, জিঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে মাটির উর্বরতা কমছে, গাছের বৃদ্ধি কমছে এবং ফসল উৎপাদনও কমছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় মাত্র ৩০ ভাগ জমি চাষযোগ্য, ৫৩ ভাগ পতিত এবং ১৭ ভাগ জায়গায় মাছচাষ হয় ।
সংশ্লিষ্টরা বলছে,সমগ্র পৃথিবীর উপকূলীয় আবাসস্থল অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল হতে অতিরিক্ত কাঠ ও মাছ আহরণের ফলে এবং উপকূলীয় ভূমিকে বিকল্প ব্যবহার যোগ্য ভূমি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এ বনাঞ্চল হুমকির সম্মুখীন। এত কিছুর পরও রাষ্ট্রীয় ভাবে আমরা আশীর্বাদস্বরূপ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছি না।
Check Also
সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …