ছবি আছেঃ আবু সাইদ বিশ^াসঃ সাতক্ষীরাঃ ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, বনের ভেতরে স্থিত নদীতে নৌ-চলাচল, শিল্পকারখানা স্থাপন, অবৈধ শিকার, খাদ্য সংকটের কারণে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘ বসবাসের পরিবেশ সংকট হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশে সম্প্রকি বছর গুলোতে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ বন দপ্তরের বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের বাঘগুলো পশ্চিমবঙ্গের অংশে চলে আসাই বাঘ বাড়ার প্রধান কারণ। ২০২১ সালে বাঘশুমারি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৯৬টি। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২৩টিতে। তাদের ধারণা ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েক বছরে এত বাঘ পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে বাড়ার কারণ হিসেবে রাজ্য বন দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত দুটো কারণে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে খাদ্যের অভাব ও যৌনসঙ্গীর খোঁজে ওপার বাংলা থেকে বহু বাঘ এপার বাংলায়চলে আসছে। তাছাড়া বাঘের বংশবৃদ্ধি তো রয়েছে। পুরো সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ পড়েছে বাংলাদেশে আর বাকি ৪০ শতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। বাংলাদেশ অংশে খাদ্যের অভাব হলেও পশ্চিমবঙ্গে খাবারের অভাব দূর করতে নিয়মিত হরিণ ও শুয়োরের মাংসের জোগান দেয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। তাদের দাবী খাবারের টানেই মূলত বাংলাদেশ অংশ থেকে বাঘ যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। ভারত তাদের বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিগত কয়েক বছর যাবত অরণ্য সংরক্ষণের উপর জোর দিচ্ছে। ফলে গত ১৪ বছরে ভারতে অভয়ারণ্যের সংখ্যা ২৮ থেকে ৫০ শে উন্নীত হয়েছে। ২০০৪ সালে বাংলাদেশের সুন্দরবনে প্রায় ৪০০টি বাঘ ছিল । ২০১৭ সালে তা ১৫০টিতে নেমে আসে। আর এখন তা ১২০টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
বাঘের প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা করা এবং বাঘ সংরক্ষণের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রতি বছরের ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঘ করি সংরক্ষণ, সমৃদ্ধ হবে সুন্দরবন’। এ উপলক্ষে সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জে খুলনা, সাতক্ষীরা, চাঁদপাই ও শরণখোলায় আলাদাভাবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সমাবেশ, শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা মুন্সিগঞ্জের বুড়িগোয়ালিনীতে র্যালী ও আলোচনা সভার মাধ্যমে বিশ্ববাঘ দিবস পালিত হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আয়োজনে বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশন থেকে একটি র্যালী বের হয়। এরপর বুড়িগোয়ালিনী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বন্যপ্রানী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষক মফিজুর রহমান চৌধুরী, সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা ফজলুল হক, বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নূর আলম।
উল্লেখ্য, বিশ্বেবাঘ রয়েছে এমন ১৩টি দেশ আজ এই বাঘ দিবস পালন করছে। ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত বাঘ অভিবর্তনে এ দিবসটির সূচনা হয়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে ৩৫০টি বাঘ ছিল। এরপর ১৯৮২ সালে জরিপে৪২৫টি ও এর দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে সুন্দরবন দক্ষিণ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ১১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জরিপ চালিয়ে৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। ১৯৯২ সালে ৩৫৯টি বাঘ থাকার তথ্য জানায় বন বিভাগ। পরের বছর ১৯৯৩ সালে সুন্দরবনের ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্যাগমার্ক পদ্ধতিতে জরিপ চালিয়ে ধন বাহাদুর তামাং ৩৬২টি বাঘ রয়েছে বলে জানান। ২০০৪ সালে জরিপে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা ৩৫০টি থেকে৪০০টি উল্লেখ করা হয়। ওই সময়ে বাঘের পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে গণনা করা হয়। ২০১৫ সালের জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। হঠাৎ করে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪০০টি থেকে ১০৬ টিতেএসে দাঁড়ালে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। ২০১৮ সালে সর্বশেষ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১১৪ টি। কিন্তু পূর্ব সুন্দরবনে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট থেকে ২০২২সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছরের ব্যবধানে ৪ টি বাঘের মৃত দেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। অপরদিকে ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি পাচারকালে ১ টি বাঘের চামড়া সহ এক পাচারকারীকে আটক করে র্যাব-৮ ও বনবিভাগ। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে বাঘের একটি মৃতদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ এবং র্যাব-৬ একই রেঞ্জ থেকে চলতি বছরে একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে। এ হিসাব থেকে কমে গেল ৭টি বাঘ। এ মুহূর্তে সুন্দরবনে কয়টি বাঘ আছে তার সঠিক হিসাব নেই বনবিভাগের কাছে। ২০২৪ সালের জুন মাসের দিকে বাঘ গণনার ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশে বাঘের খাবারের ৫০ শতাংশ হরিণের মাংস থেকে এবং বাকি ৫০ শতাংশ শূকরের মাংস থেকে আসে। আর খুলনা-বাগেরহাট অংশে বিচরণকারী বাঘ খাবারের ৭০ শতাংশ মেটে হরিণ থেকে। আর বাকি ৩০ শতাংশ আসে শূকর ও অন্যান্য প্রাণী থেকে। সামগ্রিকভাবে বাঘের খাবারের ৮৯ শতাংশ আসে হরিণ ও শূকর থেকে। গবেষকেরা বলছেন, বাঘ যদি মাছ ও কাঁকড়া খায়, তাহলে বুঝতে হবে সুন্দরবনে খাদ্যসংকট চলছে। ২০১৯ সালে বন বিভাগের পক্ষ থেকে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নিয়ে একটি জরিপ করেন। এতে দেখা যায়, বনের আয়তন অনুযায়ী সেখানে ২৬৪টি বাঘ থাকতে পারে। তবে বাঘ আছে ১১৪টি।
সুন্দরবন বিভাগের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মহসিন জানান, খাদ্যাভাবে বাংলাদেশের বাঘ ভারতে যাওয়ার তথ্য সঠিক নয়। বাঘের একটা নির্দিষ্ট টেরিটোরি আছে। আহত বা পরাস্থ না হলে এই টেরিটোরির বাইরে যায় না বাঘ। সুন্দরবনের কটকায়যে বাঘটা আছে সে কোনোদিন কয়রা বা সাতক্ষীরায় যাবে না। কয়রা বা সাতক্ষীরাতে যে বাঘটা আছে সে সুন্দরবনে আসবে না। এক টেরিটোরির বাঘ অন্য টেরিটোরিতে গেলে মারামারি হবে। এটাকে বলে টেরিটোরি ফাইট। বাঘ যার যার টেরিটোরিতে একাই থাকে।’ তিনি বলেন, ‘২০০৫ সালের একটা গবেষণায় দেখা গেছে সুন্দরবনে একটা বাঘিনীর টেরিটোরি হলো ১৫-১৭ বর্গ কিলোমিটার। এই এলাকায় দুই-তিনটা বাঘিনী থাকবে। কিন্তু বাঘ থাকবে একটাই। আরেকটা শক্তিশালী বাঘ এখানে আসলে ফাইট হবে। পশ্চিমবঙ্গে যে বাঘগুলো আছে তারও টেরিটোরি আছে।’আবু নাসের মহসিন বলেন, ‘মূল বিষয়টা হলো ধারণক্ষমতা কতটুকু? টেরিটোরি অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২০০ থেকে ২২০টি বাঘের ধারণক্ষমতা আছে। বাঘ বিশেজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে যদি বাঘের ধারণ ক্ষমতা ২শ থেকে ২শ২০টি হয় তাহলে ভারত অংশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেশি কেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ানো যাবে, যদি হরিণ সংরক্ষণের উদ্যোগ বাড়ানো হয়।
Check Also
ব্যাংকার’স এসোসিয়েশন সাতক্ষীরার বর্ষপূর্তি উদযাপন ও কমিটি গঠন
সভাপতি মোঃ আব্দুর রহিম (জনতা ব্যাংক), সম্পাদক কবির উদ্দিন (আল আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক) আব্দুল্লাহ আল …