সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই একশ্রেণির জেলে গহীন বনের বিভিন্ন খালে বিষ ছিটিয়ে চিংড়ি ধরছেন। এরপর গাছ কেটে চিংড়ি শুকানোর জায়গা করা হয়। সেখানে চিংড়ি শুকাতে পোড়ানো হয় কাঠ। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর।
বন্য প্রাণী এবং নদী-খালের মাছের বিচরণ ও প্রজনন কার্যক্রমের সুরক্ষায় গত ১ জুন থেকে সুন্দরবনে প্রবেশে সব ধরনের অনুমতি বন্ধ রেখেছে বন বিভাগ। চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
এর মধ্যে সম্প্রতি বনের পাতকোস্টা, ভোমরখালী, পাশাখালী, গেওয়াখালী, মার্কি, আদাচাকি ও ভদ্রা এলাকায় এমন কয়েকটি চিংড়ি শুকানোর স্থান চিহ্নিত করে তা উচ্ছেদ করেছে বন বিভাগ। সর্বশেষ গত ২২ জুলাই কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের বনরক্ষীরা গহিন বনের মধ্যে এমন একটি চিংড়ি শুকানোর স্থান ধ্বংস করেছেন।
অভিযানের বিষয়ে কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায় বলেন, বনের সুন্দরী, পশুর, গেওয়াসহ অনেক প্রজাতির গাছ কেটে একই স্তরে সাজিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো হয় মাচা। বনের কাঠ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেখানে চিংড়ি শুকনো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বন বিভাগ ও পুলিশের অভিযানে গত দেড় মাসে সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে ধরা ১ হাজার ১০ কেজি চিংড়ি জব্দ করা হয়েছে। এর বাইরে ১৯ জুলাই রাতে কয়রার কাশিরহাটখোলা এলাকা থেকে বিষ দিয়ে শিকার করা ৩১০ কেজি চিংড়িসহ একজনকে আটক করে পুলিশ। ২১ জুলাই গহিন সুন্দরবনের খাল থেকে দুই বোতল বিষসহ দুই জনকে আটক করে কোবাদক ফরেস্ট স্টেশনের বনরক্ষীরা।
সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, এ ব্যাপারে বন বিভাগের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন মঠবাড়ি এলাকার বনজীবী জেলে আনারুল ইসলাম বলেন, বিষ দিয়ে শিকার করা চিংড়ি লোকলয়ে আনা যায় না। গোপনে পাইকারি আড়তে বিক্রিও হয় না। অসাধু জেলেরা এখন বনের মধ্যে মাচা করে আগুনের তাপে চিংড়ি শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করে কৌশলে শহরে পাঠাচ্ছেন।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারতের হেমনগর ও কলকাতা বন্দর থেকে সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন আংটিহারা শুল্ক অফিস হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ছোট জাহাজ। এসব জাহাজের কর্মীদের মাধ্যমেও হরিণের মাংস ও বিষ দিয়ে ধরা চিংড়ি পাচার হয়। গত ৬ মার্চ আংটিহারা বাজারের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ জাহাজের চার শ্রমিককে আটক করে পুলিশে দেন স্থানীয়রা।
জেলেরা বলছেন, সুন্দরীগাছের আগুন চিংড়ি শুকানোর জন্য বেশ ভালো। এতে শুকানো চিংড়ির রং অনেকটা লালচে হয়। বাজারে ওই চিংড়ির চাহিদা ও দাম বেশি। আগে কয়রার বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের চিংড়ি শুকানোর কারখানা (খুঁটি) ছিল। গত দুই বছরে বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৩০টি খুটি উচ্ছেদ করেছে। এর পর থেকে বনের মধ্যেই চিংড়ি শুকানোর ব্যবস্থা করছেন অসাধু জেলেরা।
সম্প্রতি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এরকম একটি চিংড়ি শুকানোর স্থান উচ্ছেদ করেছেন সুন্দরবনের নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমান। তিনি বলেন, সব ধরনের তথ্য থাকার পরও ওই জায়গা খুঁজে বের করতে টানা তিন দিন সময় লেগেছিল। স্থানটি সুন্দরবনের এতটাই গহিনে যে ভাটার সময় নৌকা নিয়ে যাওয়া যায় না। জোয়ারের সময়ও ছোট নৌকা ওই খাল দিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হয়। খালের পাড় থেকে প্রায় ৪৫ মিনিট হেঁটে যাওয়ার পর ওই স্থানটি পাওয়া যায়।
বন বন্ধ থাকলেই এ ধরনের প্রবণতা বেড়ে যায় বলে জানালেন সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন। তিনি বলেন, ব্যাপারটি খুবই উদ্বেগের। এতে একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বনের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এর সঙ্গে বনসংশ্লিষ্ট কেউই জড়িত নন। বনকর্মীরা সচেষ্ট আছেন বলেই এত এত চিংড়ি ধরা পড়েছে।