মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় দুই কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে তিন দলের বৈঠক অনঢ় আ.লীগ-বিএনপি, সমঝোতা চায় যুক্তরাষ্ট্র

    • সরকারি দল বলছে– সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন
  • বিএনপি বলছে ‘নাজাপা চায় সব দলের অংশগ্রহণ

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে উত্তাপ ছড়াচ্ছে রাজনীতি। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে দেশের দুই রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিানর অধীনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনও সেই পথেই এগোচ্ছে। আর শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়- বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে বিএনপি।

নিজ নিজ দাবিতে দুই দলের এই অনড় অবস্থানে সহিংসতামুক্ত সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সংশয় দেখছেন বিদেশী কুটনীতিকরা। এ বিষয় নিয়ে সম্প্রতি বিদেশী কুটনীতিকদের আনাগোনা বেড়েছে ঢাকায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও মার্কিন মুলুকসহ বিদেশী ক্ষমতাশালী দেশগুলোও বিষয়টির সুরাহা চাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন এসব কুটনীতিকরা।

সবশেষ নির্বাচন নিয়ে দুই দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের বরফ গলাতে গতকাল ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের গুলশানের বাসায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি এবং সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের দুই কংগ্রেসম্যান এড কেইস (ডেমোক্রাট) ও রিচার্ড ম্যাকরমিক (রিপাবলিকান)। উপস্থিত ছিলেন পিটার হাসও। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের এ দুই সংসদ সদস্য বাংলাদেশের ওই রাজনৈতিক দল তিনটির প্রতিনিধিদের নিয়ে বিকাল চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত দেড় ঘন্টা বৈঠক করলেও বরফ গলেনি। হয়নি চূড়ান্ত সুরাহা।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান, নাহিম রাজ্জাক ও তামান্না নুসরাত। তিনজনই সংসদ সদস্য। অন্যদিকে বিএনপির প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলটির প্রচার সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদলে ছিলেন তিন সংসদ সদস্য- শেরিফা কাদের, রানা মোহাম্মদ সোহেল ও নাজমা আকতার।

বৈঠকে সূত্র বলছে, বিএনপির পক্ষ থেকে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না উল্লেখ করে দলের অবস্থান তুলে ধরেন। একই সঙ্গে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলেও ওই বৈঠকে জানান তিনি। তার অভিযোগ ছিল, দেশে এক ব্যক্তির শাসন চলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- এটাই তারা সেখানে বলেছেন। কেন আজকে এক দফা দাবির আন্দোলনে নামতে হয়েছে, এর প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের বৈঠকে।

এদিকে বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বিধান রাখা সম্ভব নয়।

সূত্র জানায়, বৈঠকে কংগ্রেসম্যান এড কেইস আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলকে বলেন, শুধু তোমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীর কাছে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে। জবাবে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হিসেবে তাঁদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। একই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির কথা জানান।

বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কী কারণে, সেই বিষয়টি তুলে ধরেন দুই কংগ্রেসম্যান। এর মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইন্দো-প্যাসিফিকে অঞ্চলে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। সারা পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা কমে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে, সেটা চায় আমেরিকা।

আইনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করেছে বলে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে জানান আওয়ামী লীগের এক সদস্য। তিনি আরও বলেন, সামনের অধিবেশনে আরেকটি আইন আসবে। সেখানে নির্বাচনের সময়ে বিশৃঙ্খলা করা বা বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান রাখা হবে।

এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির শেরিফা কাদের বলেন, তারা সব সময় যা বলেন, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দরকার এবং নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ যাতে নিশ্চিত হয়, সেটাই তারা বলেছেন।

এর আগে গতকাল দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন পদ্মায় বাংলাদেশে সফররত মার্কিন কংগ্রেসের দুই সদস্য এক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের কাছে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছেন। নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতার পথ আছে কি না, সেটাও জানতে চেয়েছেন তারা।

মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের আলোচনার বিষয়ে জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ চীনের খপ্পরে পড়েছে কি না, তা- মার্কিন কংগ্রেসের দুই সদস্য জানতে চেয়েছেন।

রাজনৈতিক সমঝোতা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তারা (কংগ্রেস সদস্য) বলেছে, তোমাদের কোনো সমঝোতার পথ আছে কি না ওদের (বিএনপি) সঙ্গে। আমরা বলেছি, তাদের যে দাবি, সরকারের পদত্যাগ, ওটাতে সমঝোতার কোনো স্কোপ নেই।’

মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের কাছে তাদের দেশে নির্বাচন উপলক্ষে সরকারের পতন হয় কি না, সে প্রশ্ন রেখেছেন আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় তোমাদের দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) কি সরকারের পতন হয়? নিশ্চয়ই না। এমন দাবি থাকলে তোমরা কি আলোচনায় বসবে? ওগুলোর প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমরা আমাদের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন করব।’

দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা থাকলে সুষ্ঠু ও সহিংসতা ছাড়া নির্বাচন সম্ভব বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, যতগুলো দল আছে সব দল যদি নির্বাচনে যোগদান করে, তারা যদি আন্তরিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতা ছাড়া নির্বাচন চায়, তাহলে নির্বাচন সহিংসতা ছাড়া হবে। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সহিংসতা ছাড়া নির্বাচন হবে।

সরকার বা নির্বাচন কমিশন চাইলে সহিংসতা ছাড়া নির্বাচনের বিষয়ে ‘গ্যারান্টি’ দেওয়া যায় না বলে উল্লেখ করেন আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘তাদের (দুই কংগ্রেস সদস্য) কাছে বিভিন্ন লোকজন বলেছে, বাংলাদেশ একটি ভয়ংকর জায়গা। এরা চীনের খপ্পরে পড়ে গেছে। চীনের গোলাম হয়ে গেছে। এখানে অশান্তি আর অশান্তি। পুলিশ সব লোকজনকে ধরে মেরে ফেলছে। এই ধরনের একটি ধারণায় ভয় তাদের। তবে এসব কোনোটিই সত্য নয়।’

নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে, এ বিষয়ে কংগ্রেস সদস্যরা আশ্বস্ত হয়েছেন কি না, সে প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সেটি তাদের জিজ্ঞেস করুন।’

Check Also

পঁচিশেই নির্বাচন চায় বিএনপি ও সমমনারা

দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা মিত্র দলগুলোর …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।