অবহেলিত ও বঞ্চনার শিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠিঃ পেশা পরিবর্তনে হচ্ছে উদ্বাস্তু: নিঃসম্বল হচ্ছে প্রান্তিক চাষি
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনে উপকূলীয় এলাকার কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি ভেঙ্গে যাচ্ছে। কর্মস্থল হারাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণক্ষতা ও কৃষি খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্ধের অভাবে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলা সমূহে কৃষক সমাজ অবহেলিত ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। কঠোর পরিশ্রম ও কৃষি সাধনার পরও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। বরঞ্চ পেশা পরিবর্তস সহ উদ্বাস্তু হচ্ছে অসংখ্য কৃষক। মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে ফসলের ফলন কমে যাচ্ছে। ঝড় জলোচ্ছাস বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উপকূলীয় এলাকার কৃষি, মাছচাষ সহ প্রতিটি ক্ষেত্রই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে । এতে উপকূলীয় এলাকার মানুষদের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্যোগে মানুষদের সহায়সম্বল হারাতে হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভর উপজীবিকারা তাদের জীবিকা হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এতে দেশের বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। যেমন মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় স্বাদু পানির জেলে, সমুদ্র্রগামী জেলে এবং মোহনাগামী জেলে তাদের জীবিকার উৎস হারাচ্ছে। বর্তমানে এরকম ঝুঁকির মধ্যে এক লাখেরও বেশি জেলে। এছাড়াও জলোচ্ছ্বাসে ধুয়ে নিয়ে যায় উপকূলবর্তী মানুষের একমাত্র সহায় গবাদি পশু, ফসল ও ফসলের জমি। অনেক প্রান্তিক চাষী ঋণ করে জন্মানো ফসল হারিয়ে হয়ে পড়েছে নিঃসম্বল। এর ফলে উপকূলীয় এলাকার লোকেরা শহরমুখী হচ্ছে এবং শহরে সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সূত্র অনুযায়ী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। সে সময় চাষাবাদযোগ্য ২৫৫ লাখ একর জমিতে ১০০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হতো, সে তুলনায় ২০২২ সালে জনসংখ্যা সাড়ে ১৭ কোটি দাঁড়ালেও এ সময় ২৫০ লাখ একর জমিতে ধান উৎপাদিত হয়েছে ২৯৮ লাখ মেট্রিক টন অর্থাৎ প্রায় ৩ গুণ। দ্বিগুণ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য তিনগুণ বর্ধিত খাদ্যশস্য উৎপাদন নিঃসন্দেহে খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। কৃষি বিপ্লবের এই অগ্রসাধক হলো দেশের আপামর কৃৃষক সমাজ। কিন্তু বরাবরই তারাই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। কৃষির সামগ্রীক বিবেচনায় উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিঅর্থনীতির অবদান তুলনামূলকভাবে নিম্নমুখী। উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি খাত প্রধানত শস্য ও অশস্য (নন-ক্রপ) এ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তারা বলেন, প্রথমত বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত হওয়ার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদন তুলনামূলকভাবে এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পায়নি। একটি গবেষণায় দেখা যায় ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৭ সালের মধবর্তী মাত্র ১৩ বছরে জাতীয় পর্যায়ে যেখানে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ শস্য (খাদ্য ও অর্থকরী ফসল) উৎপাদিত হয়েছে সেখানে উপকূলীয় অঞ্চলে একই সময়ে শস্য উৎপাদন বাড়েনি বরং কমেছে। উজান থেকে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও চাষাবাদ পদ্ধতি প্রক্রিয়ায় নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েও কাঙ্খিত ফল আসেনি।
বঙ্গোপসাগরের তীরে ও বিশ্বের সেরা গহিন গরান বনের নীড়ে গড়ে ওঠা গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র বিলাস। প্রকৃতি এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের ভালোবাসা দিয়ে রানীও করেছে আবার ভিখারীও বানিয়েছে। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্তনদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল। দেশের শতকরা ২৫ ভাগ জনগণ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এই অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল, এখানকার অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানান দৈব-দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, মোদ্দা কথায় সময়ের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথাসময়ে যথাপ্রযতœ প্রদান করা সম্ভব না হলে, উষ্ণায়নের প্রভাবক ক্ষয়ক্ষতিকে যথা নিয়ন্ত্রণ ও মোকাবিলা করা সম্ভব না হলে সমূহ সম্ভাবনাময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অবদান থেকে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতি শুধু বঞ্চিতই হবে না, সময়ের অবসরে জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি গোটা দেশ ও অর্থনীতির জন্য দুর্ভাবনা-দুর্গতির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে।