যুক্তরাজ্য থেকে ডাঃ আলী জাহান”
১. তিনি ফিরে এসেছেন। পাঁচ বছর ভারতের কারাগারে বন্দি থেকে পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি দেখলাম ফিরে এসেছেন। তাও আবার গতকাল সরাসরি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর জানাজার অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন যে, সাঈদী রাজাকার ছিলেন না। অনেকেরই মনে থাকার কথা যে, এই সাদা সিধে লোকটা সাঈদী সাহেবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র পক্ষের সাক্ষী ছিলেন। শেষ মুহূর্তে তিনি আসামির পক্ষে বাদীর বিপক্ষে আদালতে বক্তব্য দেয়ার জন্য আসলে আদালত প্রাঙ্গন থেকে কিডন্যাপের শিকার হোন। কয়েকদিন পর চোখ বাঁধা অবস্থায় ভারতে নিজেকে আবিষ্কার করেন। তার পরের ইতিহাস কিছু দীর্ঘ। মানবজমিন ডিজিটালের ভিডিওতে সুখরঞ্জন তার কাহিনী কিছুটা
বর্ণনা করেছেন। অবশ্য তার বক্তব্য যাদের শোনার কথা তারা বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। সাঈদী সাহেব এখন আর নেই।
২. প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাঈদী এখন এ জটিল ও নিষ্ঠুর পৃথিবীতে নেই।
বিজ্ঞাপন
সারা জীবন যে বিশ্বাসের লালন, প্রচার এবং প্রসারে সময় ব্যয় করেছেন, সেই বিশ্বাসের মূল উৎসের কাছে তিনি ফিরে গেছেন। কিন্তু কীভাবে? নিছক মৃত্যু অথবা অবহেলা/ হত্যার শিকার হলেন?
৩. আল্লামা সাঈদী যে clinical negligence এর মতো অপরাধের শিকার হননি তা প্রমাণের দায়িত্ব উনার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা কার্ডিওলজিস্ট অধ্যাপক মোস্তফা জামানের উপর। সেই সাথে পিজি হাসপাতাল বা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব রয়েছে ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার।
৪. আমি কার্ডিওলজির ডাক্তার নই। এমবিবিএস পড়তে যতটুকু কার্ডিওলজি বুঝতে হয় সে পর্যন্তই হার্ট সম্পর্কে আমার জ্ঞান। তবে এ প্রতিবেদন লেখার আগে অধ্যাপক জামানের ভিডিও ক্লিপ দেখা ছাড়াও কয়েকজন কার্ডিওলজিস্টের সাথে কথা বলেছি। আমি বায়বীয় অভিযোগ করছি না।
পিরোজপুরে মাওলানা সাঈদীর নামাজে জানাজা
৫. ২০১২ সালে মাওলানা সাঈদীর প্রথম হার্ট এ্যাটাক হলে বারডেম হাসপাতালে তিনি ভর্তি হোন। মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুসারে উনার Coronary Angiogram করা হয় এবং হার্টে স্টেন্ট লাগানো হয়। বারডেম হাসপাতালে যাবার আরেকটি কারণ ছিল যে, উনার ডায়াবেটিস ছিল। এর পর তিনি দীর্ঘদিন হার্টের কোনো বড় সমস্যায় পড়েননি।
৬. তবে দুদিন আগে হার্ট এ্যাটাক হলে কোথায় ভর্তি হবেন তা নিয়ে সমস্যা হয়েছে। বুকে ব্যথা অনুভব করলে কাশিমপুর কারাগার থেকে তাকে প্রথমেই নেওয়া হয় গাজীপুরের তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ওখানে হার্ট এ্যাটাক কনফার্মড হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে পাঠানো হয়। উনার হার্টের স্টেন্ট লাগানো হয়েছে যে বারডেম হাসপাতালে (Cardiac Centre)সেখানে না নেওয়ার কোন কারণ আছে? কেন বারডেমে যোগাযোগ করা হয়নি অথবা পরিবারকে যোগাযোগ করতে বলা হয়নি?
৭. পরিবর্তে তাকে নিয়ে আসা হলো মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন মানের চিকিৎসা হয় তা জানতে হলে ওখানে আপনাকে ভর্তি হতে হবে । ওখানে অবাক হয়ে দেশবাসী দেখলো যে, হার্ট এ্যাটাকের রোগীকে এম্বুলেন্সে থেকে নামিয়ে হাঁটিয়ে হাসপাতালের ভেতর নেওয়া হচ্ছে। একটু হাঁটলেই যে exertion হবে সে কারণে যে হার্ট এ্যাটাক হতে পারে বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। অধ্যাপক জামান, আপনার কোন ব্যাখ্যা আছে?হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে হার্ট এ্যাটাকের রোগীকে সিসিইউ-তে নিয়ে গেলেন!
৮.ভিডিওতে ডাক্তার জামান বলছেন যে, উনারা প্রথমেই মাওলানা সাঈদীকে PCI (Per Cutaneous Intervention) করার সিদ্ধান্ত নেন। পরে রোগীর বুকে ব্যথা না থাকার কারণে তারা PCI না করে কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। PCI না করার অন্য কারণ ছিল? আপনি কেন এমনটি করলেন? এটি একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কার্ডিওলজি বইয়ের কোথাও লেখা নেই যে, বুকে ব্যথা না থাকলে PCI করার প্রয়োজন নেই। এটা পাগলের প্রলাপ। PCI না করার অন্য কারণগুলো উনার ক্ষেত্রে তো প্রযোজ্য ছিলো না।এখন আপনাকে বলতে হবে যে আপনারা কেন PCI করতে যাননি? Cearly, it’s a medical
negligence which can be a crime. এর ব্যাখ্যা দিয়ে আপনি নিজে বাঁচুন, অন্য ডাক্তারদের বাঁচান। পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও অনেকেই বলছেন এটি একটি খুন, পরিকল্পিত খুন।
মানুষ ছুঁটছে মাওলানার জানাজায়
৯. ধরে নিলাম হাসপাতালের ভেতর উনি খুব ভালো ছিলেন এবং আপনারা অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গুরুতর হার্ট এ্যাটাকের রোগী, উনার ছেলে বা পরিবারের অন্য কাউকে মাওলানা সাঈদীকে দেখার সুযোগ দিয়েছিলেন? কেন দেননি? কী ব্যাখ্যা আছে?
১০. পরিবার তো বলছে আপনারা তাকে চিকিৎসা না দিয়ে তাকে হত্যা করেছেন। ভদ্র দেশে হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এতক্ষণে রোগীর আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ করত। তদন্ত কমিটি গঠন করত। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সাসপেন্ড করত। Clinical negligence ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের তাদের রেগুলেটরি বডির (বাংলাদেশে BMDC) কাছে রেফার করত এবং তদন্ত ও শুনানি শেষে রায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্র্যাকটিস এবং চাকুরি থেকে বিরত রাখতো। বাংলাদেশে এসবের কোন অস্তিত্ব আছে বলে আমার জানা নেই। ওখানে আপনারা স্বাধীন।
১১. মুমূর্ষু রোগীকে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা না করতে দেওয়া কোনো মানবিক কাজ হতে পারে না। এটি একটি অপরাধ। এ অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন কারা? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় কি একটু তদন্ত করতে পারবেন?
১২. মৃত্যুর পর সাঈদী সাহেবের পরিবার এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁর একটি জানাজা বায়তুল মোকাররম মসজিদে করতে চেয়েছিলেন। ডিএমপি পুলিশ কমিশনার তা করতে দেননি। কেন করতে দেননি? প্রেস কনফারেন্সে ওনার বক্তব্য দেখলাম। উনি বলছেন ওখানে গোলমাল হতে পারে তাই অনুমতি দেওয়া গেল না। আর কোন যুক্তি আছে? মসজিদে এখন জানাজা করতেও পুলিশের অনুমতি নিতে হয়? আর কী কী করতে অনুমতি লাগবে তা যদি পুলিশ মানুষকে একটু আগাম জানান তাহলে উপকার হয়। পিরোজপুরে মাওলানা সাঈদীর যে জানাজা হয়েছে ওখানে কি গোলমাল হয়েছে? বিজ্ঞ পুলিশ কমিশনার কী জবাব দেবেন? ভালো কথা, দেশের অন্য স্থানে গায়েবানা জানাজায় বাঁধা দিচ্ছেন কেন? চকরিয়ায় তো একজনকে গুলি করে মেরেই ফেলা হয়েছে।
১৩. মাওলানা সাঈদীর পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সুখরঞ্জন বালির আদালত পাড়া থেকে অপহরণ এবং অলৌকিকভাবে ভারতে চলে যাওয়ার কোনো তদন্ত হবে না? মুক্তিযোদ্ধা সুখরঞ্জনের রাষ্ট্রপক্ষ ত্যাগের কোনো ব্যাখ্যা আসবে না? Clinical negligence or a murder এর কোন তদন্ত হবে? পুলিশকে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারবে একজন মৃত মানুষের জানাজা পড়ার জন্য কেন তাদের অনুমতি লাগবে? কেন তারা মাওলানা সাঈদীর জানাজা ঢাকায় হতে দিলেন না? ওনার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা প্রকাশ হয়ে যেত সেই ভয়ে?
১৪. মৃত্যু কারো কাছেই প্রত্যাশিত নয়। তারপরেও মৃত্যু ঘটবে। কখন ঘটবে, কীভাবে ঘটবে তা কেউ বলতে পারে না।কিন্তু আমাদের সকলকে এক সময় চলে যেতে হবে। মানুষের অভিশাপ নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত আছেন? যদি থাকেন, তাহলে আমার আর বলার কিছু নেই। মানুষের অভিশাপকে ভয় করুন। এই অভিশাপ আপনার জীবনকে কীভাবে ছিন্নভিন্ন করে দেবে তা হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না।
ডাঃ আলী জাহান
যুক্তরাজ্য প্রবাসী চিকিৎসক
সাবেক পুলিশ সার্জন, যুক্তরাজ্য
alijahanbd@gmail.com