আবু সাইদ বিশ্বাস, ক্রাইমবাতা রিপোট, সাতক্ষীরাঃ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে খাদ্যমূল্যের দাম বাড়ায় সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। এতে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় শহরের চেয়ে অধিক হারে বাড়ছে। বেঁচে থাকার লড়ায়ে ধার দিনা করছে চলছে নি¤œ আয়ের মানুষ। দুযোর্গে ক্ষতিগ্রস্থ পোল্ডারগুলোর সংস্কার শেষ না হওয়ায় অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ এখনো ঘরে ফিরতে পারেনি গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও অস্বাভাবিক জোয়ারে উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে সাতক্ষীরা জেলা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ২৩ লক্ষ মানুষের বসবাসরত জেলাটির ১০ লক্ষ মানুষই কৃষি পরিবারের সাথে জড়িত। ৫ শতাংশের নিচে জমি আছে এমন মানুষের সংখ্যা ৬৫ হাজার। ১ লক্ষ ৪২ হাজারের বেশি প্রান্তিক চাষি আছে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে। দেড় লক্ষের অধীক আছে ক্ষুদ্র চাষি। এদের অবস্থা এখন অন্যন্ত নাজুক। বিশেজ্ঞরা বলছে, কৃষিভিত্তিক নিত্যপণ্যের উৎপাদন গ্রামে হলেও মজুদ গড়ে উঠছে শহরে। উৎপাদনের পরপরই সেগুলোর বেশির ভাগই কৃষকের হাত থেকে চলে যাচ্ছে জমুতদারদের নিয়ন্ত্রণে। তারা কম দামে কিনে বেশি দামে গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করছে। এতে পরে নিজের উৎপাদিত পণ্যই বাড়তি দামে কিনছে কৃষক। এসব কারণেই মূল্যস্ফীতির হার গ্রামে অধিক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি যাচ্ছে গ্রামে। এগুলোর ৫৩ শতাংশই ভোগ বিলাসে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে অনুৎপাদনশীল খাতে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। মূলত এ দুটি কারণেই গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে। এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান নি¤œগামি হচ্ছে।
গত বছরে জুলাই মাস পর্যন্ত শহরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। কিন্তু গ্রামে এ হার ৬ দশমকি ৭১ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে ১ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে একই সময়ে শহরে এ হার ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। কিন্তু গ্রামে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে এ হার দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৫.৮ শতাংশ। কিন্তু নিত্যপণ্যের বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধি বাস্তবে মূল্যস্ফীতির এই হিসাবের তুলনায় গ্রামে বহুগুণ বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হয়েছে দশমিক ৮৩ শতাংশ।
দেশের জনগণের দৈনিক ক্যালরির ৭০ শতাংশের বেশি আসে গ্রামে কৃষকের উৎপাদিত চাল থেকে। কয়েক দশকে চাল উৎপাদন তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তার পরও চালের দাম বাড়তি। খাদ্যপণ্যের, বিশেষ করে প্রধান খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি দেশের স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। একদিকে নিশ্চিত দাম বাড়া, অন্যদিকে অনিশ্চিত আয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। দ্র্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এখন তাদের কাছে মুখ্য। গ্রামে খাদ্যপণ্যের চাহিদাই বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমেছে। একই সঙ্গে গ্রামের খাদ্যের সরবরাহ বেশি হওয়ার কথা, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের সরবরাহ কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা উলটো। গ্রামে সার্বিকভাবে খাদ্যের সরবরাহ বেশি হলে মজুতদারদের কারসাজির কারণে দাম বেশি। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের জোগান স্বাভাবিক থাকলেও ব্যয়সাপেক্ষ। যে কারণে গ্রামে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে আগে শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম ছিল। গত কয়েক বছর ধরে হঠাৎ করেই গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার অধিক হারে বাড়ছে। এর একটি কারণ হতে পারে-নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার শহরে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্য বিতরণ করছে। গ্রামে সেটি শহরের মতো ব্যাপক হারে করছে না। বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, মানুষের জীবনযাত্রায় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মধ্যে কাপড়, জুতা, পরিবহণ, বিনোদন ও বিবিধ খাতে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেশি বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছরে কাপড় ও জুতার দাম গ্রামে বেড়েছে দশমিক ৬২ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশ। গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি বেড়েছে দশমিক ১৬ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে গ্রামে পরিবহণ খাতে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৩২ শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বেড়েছে দশমিক ১৫ শতাংশ। বিনোদন খাতে একই সময়ে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৭৮ শতাংশ, শহরে বিনোদনের সঙ্গে শিক্ষা যুক্ত করে ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি বেড়েছে দশমিক ৪৬ শতাংশ। বিবিধ খাতে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে দেড় শতাংশ, শহরে বেড়েছে দশমকি ৭১ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেশি বেড়েছে ৭৯ শতাংশ। এছাড়া চিকিৎসা খাতে চরম হয়রানি, প্রতরণা ও ভূল চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হয় গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের তথ্য মতে, মূল্যস্ফীতির চাপে দিশেহারা নিম্নআয়ের মানুষ, জরিপ বলছে, ৩৭% পরিবারকে এখন মাঝেমধ্যে কোনো এক বেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় কম খাচ্ছে ৭১% পরিবার। ১৮% পরিবারের লোকজনকে গত ৬ মাসে পুরো দিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপে দেশের ৭৪% নিম্নআয়ের পরিবার ধার করে চলছে। গত ছয় মাসে এসব পরিবারের ব্যয় বেড়েছে ১৩%, কিন্তু তাদের আয় বাড়েনি। ৯০% নিম্নআয়ের পরিবারগুলো অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে। বিগত ৬ মাসে ধারের উৎস হিসেবে ৪৫% পরিবার বেছে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠান। ৩৭% পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। সমবায় সমিতি থেকে ধার করছে ২৩% পরিবার। এছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ৩% পরিবার। সানেম বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ এখন ব্যাপক কাটছাঁট করে চলছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৯০% পরিবার জানিয়েছে, তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬% পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। যেমন ছয় মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে ৪ বার মুরগি খেত, এখন তারা ২ বার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮% পরিবার। এছাড়া ৭৭% পরিবার ডিম ও ৮১% পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। শহরের নিম্ন আয়ের পরিবার খাদ্য কিনতে বেশি কাটছাঁট করছে। গ্রামের পরিবারগুলো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ কমিয়েছে বেশি। সানেমের জরিপে উঠে এসেছে, ৩৭% পরিবার বলেছে, তাদের এখন মাঝেমধ্যে কোনো এক বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছে বলে মনে করে ৭১% পরিবার। ১৮% পরিবারের লোকজনকে গত ৬ মাসে পুরো দিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৬% পরিবার মনে করে, আগামী ছয় মাসে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। ৪১% পরিবার এটাও বলছে, ভবিষ্যতে তাদের ভিক্ষা বা শর্তহীন সাহায্য নিয়ে চলতে হতে পারে। সানেম আরও বলছে, খাবার জোগাড় করতে জমি বিক্রি করে চলতে হতে পারে বলে মনে করে ১৭% নিম্নআয়ের পরিবার। অবস্থা সামাল দিতে ভবিষ্যতে ঘরের শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করতে হতে পারে বলে ১৯% পরিবার জানিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসায় ২৪% পরিবার মনে করে ব্যয় কমাতে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হতে পারে। মেয়েসন্তানকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার কথাও বলছেন অনেকে। ২৫% পরিবার মনে করে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের হাতে এখন আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তারা এখন নিরুপায়।
Check Also
সন্ধ্যায় আবারো সড়ক অবরোধ তিতুমীর শিক্ষার্থীদের
রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ না করায় আবারো সড়ক …