আবু সাইদ বিশ্বস, সাতক্ষীরাঃ পৃষ্টপোষকতা পেলে সোনালী আশেঁর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারে চারকোল শিল্প। পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত অ্যাকটিভেটেড চারকোল সম্ভাবনার আশা জাগিয়েছে। দেশের মোট উৎপাদিত পাটকাঠির ৫০ ভাগ দিয়ে চারকোল উৎপাদন করতে পারলে তা বিদেশে রপ্তানি করে বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে এমন তথ্য উঠে এসেছে। আগে পাটকাঠি সাধারণত কৃষকের রান্নার জ্বালানি, ঘরের বেড়া, পানের বরজে ব্যবহৃত হতো। এরপর আখের ছোবড়ার সঙ্গে মিশিয়ে পার্টিকেল বোর্ড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হতো। এখন চারকোল তৈরির মিলে ব্যবহৃত হওয়ায় পাটকাঠির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। ভালো দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। পাটের দাম না পাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে কৃষক। একদিকে সোনালী আঁশ, অন্যদিকে রূপালী কাঠি- দুটো মিলে এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে পাটচাষে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পাটখড়ি হতে চারকোল উৎপাদন পাটের বহুমুখী ব্যবহারের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পানি বিশুদ্ধকরণ, আতশবাজি, জীবন রক্ষাকারী বিষ নিরোধক ট্যাবলেট, প্রসাধন সামগ্রী, ফটোকপিয়ার ও কম্পিউটারের কালি তৈরির কাঁচামাল হিসাবে চারকোল ব্যবহৃত হচ্ছে।“পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড চারকোল বাংলাদেশে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। যাতে কৃষকরা পাট উৎপাদন করে আগের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। ফলে দিন দিন পাট চাষ ও উৎপাদন কৃষক আগ্রহী হচ্ছে। বর্তমানে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাগুরাসহ দেশের বেশ কিছু জেলায় প্রায় ৪০টি কারখানায় সবাণিজ্যিক ভাবে চারকোল উৎপাদন হচ্ছে। এর মাধ্যমে বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ৭ হাজার ৭১ দশমিক ৪২ মেট্রিক টন চারকোল রপ্তানি করে দেশে প্রায় ৪০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে।
দেশে প্রথম ২০১২ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড চারকোল (এক্টিভেটেড চারকোল) উৎপাদন শুরু হয়। ওই বছরই সর্বপ্রথম চীনে এ পণ্য রপ্তানী করা হয় । বর্তমানে দেশে এ পণ্য উৎপাদনের ব্যাপ্তি বাড়লে আগামীতে জাপান, ব্রাজিল তুর্কিস্থান, যুক্তরাষ্ট্র,দক্ষিণ করিয়া, তাইওয়ান,কানাডা,মেক্সিকোসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চারকল রপ্তানি সম্ভাব হবে । বর্তমানে বিদেশে চারকল দিয়ে তৈরী হচ্ছে, ফেস ওয়াস, ফটোকপিয়ারের কালি, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ, দাতঁ পরিষ্কার করার ঔষধ। এছাড়া বিভিন্ন পন্য উৎপাদনে এ কার্বন ব্যবহৃত হচ্ছে। চারকোল ম্যানুফ্যাক্সারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে চারকলের এ অবারিত সম্ভাবনার কথা। জানানো হয় দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠি উৎপাদিত হয় । এর মধ্যে যদি ৫০ ভাগ পাটকাঠি চারকল উৎপাদনে সঠিক ভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন চারকল উৎপাদন সম্ভব হবে। যা বিদেশে রপ্তানী করে প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার ৫’শ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে সারা দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, যা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
সরকারী সূত্র বলছে, চারকোল উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি আয় ও রাজস্ব বৃদ্ধি ছাড়াও প্রায় ২০ হাজার লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্হানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সম্ভাবনাময় এই চারকোল শিল্প স্থাপন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকার পরিবেশবান্ধব একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের চারকোল উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানি বিষয়ে সহায়তা প্রদান; দক্ষ জনবল তৈরি; উৎপাদিত চারকোলের মান নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে সহযোগিতা প্রদান; দেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে সুযোগ সম্প্রসারণ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা প্রদান; চারকোল রপ্তানিতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা প্রদান; চারকোল শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা; চারকোল শিল্পে প্রবৃদ্ধি অর্জনে দক্ষ, উপযুক্ত ও প্রতিযোগিতা সক্ষম গতিশীল ব্যক্তিখাত সৃষ্টি; পরিবেশসম্মত উপায়ে চারকোল উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান; এবং চারকোল রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এর নির্দেশনাবলীসহ প্রযোজ্য অন্যান্য নীতি প্রতিপালন নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
সাতক্ষীরায় পাটের চেয়ে পাট কাঠির দাম তুলনা মূলক বেশি। তাই জেলার চাষিরা এবার পাটখড়ির দিকে নজর দিচ্ছেন বেশি। জেলা জুড়ে এখন চলছে সেই আয়োজন। শুধু সাতক্ষীরা জেলাতে ৮৬ হাজার বিঘা জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। যার উৎপাদিত পাটকাটির মূল্য দাঁড়াবে ২৬ কোটি টাকা। একই অবস্থা খুলনা,যশোর,কুষ্টিয়াসহ সহ সারা দেশে। কৃষি অফিস সূত্র থেকে জানা যায়, চলতি মৌসুমে ২০২৩-২৪অর্থ বছরের খুলনা কৃষি অঞ্চলের মধ্যে খুলনা জেলায় আবাদ করা হয়েছে ১৩৯৮ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছে ১৬,১১১ মেট্রিকটন বেল। বাগেরহাট জেলায় আবাদ করা হয়েছে ১৯৪৪ হেক্টর জমি। উৎপাদন হয়েছে ২৫,১৬৫ মেট্রিকটন বেল। সাতক্ষীরায় আবাদ করা হয়েছে ১১৮৫৩ হেক্টর জমি। উৎপাদন হয়েছে ১,২৮,০১২ মেট্রিকটন বেল এবং নড়াইল জেলায় আবাদ করা হয়েছে ২৩৬৪ ৫ হেক্টর জমি। উৎপাদন হয়েছে ২,৭০১৪০ মেট্রিকটন বেল। প্রতিবিঘায় ১৫মন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান,কৃষি পণ্যকে শিল্পে রূপান্তরের জন্য বর্তমান সরকার নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বন্ধ থাকা চারকল চালু ও বিদেশে পাটজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টির জন্য কৃষি মন্ত্রালয় কাজ করে যাচ্ছে।