দূষণ ও শিল্প-কারখানার চাপে সংকটাপন্ন শ্বাসমূলীয় বন (৮)

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ দূষণ ও শিল্প-কারখানার চাপে হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন । সুন্দরবন এলাকায় শিল্প কারখানা স্থাপন, যান্ত্রিক নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকারসহ নানা কারণে দূষণ বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ইউনাইটেড নেশসন্সস এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় ৯০ শতাংশ পাখি ও মাছের পাকস্থলি থেকে প্লাষ্টিকের কনা পাওয়া গেছে। প্লাস্টিক ১.৮ বিলিয়ন মেট্রিক টন গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপন্ন করছে, যা বিশ্বব্যাপী মোটের ৩.৪ শতাংশ, যার ৯০ শতাংশ নির্গমন হয়েছে প্লাাস্টিক উৎপাদন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির রূপান্তর থেকে। ইউনেসকো বলছে, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে লবণাক্ততার সমস্যা আগে থেকেই ছিল। এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানিদূষণ। একই সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে পশুর নদ খনন, বন্য প্রাণী শিকার, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, ভূমিক্ষয় ও ভাঙন, অবকাঠামো নির্মাণ ও বনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্র স্থাপন বনটিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বিশেজ্ঞরা বলছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের সম্ভাব্য ক্ষতির কারণ মনে করা হচ্ছে। রামপাল প্রকল্পের আশপাশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা স্থাপন করছে। এর ফলে ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বেড়ে গেছে। সামনের দিনগুলোয় তা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যে কিছু জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সুন্দরবনে জ্বালানি তেল ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য রাসায়নিক পণ্যবাহী জাহাজডুবিও হচ্ছে। এসব দূষণ সুন্দরবনের প্রাণীদের বসতি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ডলফিন, কুমিরসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিচরণও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা। পরিবেশ আইন অনুযায়ী সেখানে শিল্পকারখানা করা নিষেধ। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক জাতীয় কমিটি ওই এলাকায় ৩২০টি শিল্পকারখানা করার অনুমোদন দিয়েছে।

সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করলেও সেই এলাকার মধ্যে গড়ে উঠছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত ৮-১০ বছরে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ভারী শিল্প-প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, এলপি গ্যাস পস্ন্যান্ট, অয়েল রিফাইনারি, বিটুমিন, সি ফুড প্রসেসিং ফ্যাক্টরি প্রভৃতি। বনের খুব কাছেই বিশালাকৃতির খাদ্যগুদাম নির্মাণ করেছে খাদ্য বিভাগ। বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা চলে যাচ্ছে বনের মধ্যে নদী ও মাটিতে। প্রতি বছর সুন্দরবন ভ্রমণে যাচ্ছেন অসংখ্য পর্যটক। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেছিলেন ১ লাখ ৭৩ হাজার পর্যটক। কিন্তু সচেতনতার অভাবে অনেক পর্যটক চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, পানি ও কোমল পানীয়ের বোতল, খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, খাবারের প্যাকেট, ওয়ানটাইম পেস্নট ও গস্নাস ফেলছেন বনের মধ্যে মাটি ও নদীতে। অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেছেন, “২০১০ সালে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদের প্রতি লিটার পানিতে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ মিলিগ্রামে; যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা হল ১০ মিলিগ্রাম।”

সংশ্লিষ্টরা বলছে, কোনো দেশের বনকে সেদেশের হৃৎপিন্ড বলা হয়। বাংলাদেশেও সুন্দরবন নামে একটি হৃৎপিন্ড রয়েছে। যেটাকে ক্রমাগতভাবে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে আর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে । সুন্দরবন রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে কলমে থাকলেও বাস্তবে কার্যত হয় এর উল্টোটাই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শ্বাসমূলীয় বনটি দূষণ ও শিল্পকারখানার চাপে হুমকির মুখে পড়েছে। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, সুন্দরবনে গত দশ বছরে দূষণ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ।

এদিকে সুন্দরবনে প্লাস্টিক দূষণের সমাধানে সামিল হই সকলে” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বিশ^ পরিবেশ দিবস পালিত হয়েছে। প্লাস্টিকের ভয়াবহতা তুলে ধরে আমাদের প্রতিবেশ পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা গড়ে তুলতে সোমবার সকাল ১০টায় শ্যামনগর প্রেস ক্লাব থেকে শুরু করে ডাক বাংলো মোড় হয়ে প্রধান-প্রধান সড়কে প্লাস্টিক বর্জনে প্রচার অভিযান চালানো হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক’র সহযোগিতায় এই প্রচার অভিযান আয়োজন করে কোষ্টাল ইয়ূথ নেটওয়ার্ক।দূষণের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে বলে মনে করেন সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বনবিভাগ ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতায় সুন্দরবনে পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, বনের ইসিএ এলাকায় স্থাপিত অনেক শিল্প কারখানা ও বনের মধ্য দিয়ে জলযান চলার কারণে সুন্দরবনে দূষণ বেড়েছে। দূষণের কারণে এর জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়লেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। সরকারকে শুধু সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের অংশ হিসেবে সুন্দরবনবিনাশী সব প্রকল্প বাতিল করতে হবে বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, দেশে এখন এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যারা সুন্দরবন রক্ষায় কথা বলে, তাদেরই সরকারি লোকজন ও সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে শত্রু হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু এই সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব সরকার-জনগণ সবার।

সুন্দরবন বাঁচাতে নিন্মক্ত পদক্ষে গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেজ্ঞরা । তারা বলেন, বাংলাদেশের গৃহীত পরিবেশ নীতি, আইন ও বাংলাদেশের সমন্বিত উপকূল ব্যবস্থাপনা কৌশলের আলোকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এবং এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও কনভেশনের আলোকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ সব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিভাগের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা ও সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সুন্দরবনকে সংরক্ষণ ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা এবং এ লক্ষ্যে সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করা আশুকরণীয়। সুন্দরবন অঞ্চলকে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা যায় ও বনের বৈচিত্র্য রক্ষা করে কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় তার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।