আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জেলার ২৩৮ কিলোমিটার ভারতীয় সীমান্তসহ সারাদেশের ১ হাজার ১৬২ কিলোমিটার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে দেদারছে ঢুকছে মাদকদ্রব্য। বর্তমানে সুন্দরবনকে টার্গেট করে কয়েক দেশের মাদক কারবারিরা হাত বদল করে বাংলাদেশে মাদকের ব্যবসা করছে। এছাড়াও সীমান্তের ২৪ জেলার ৬১২টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিলের চালান আসছে অহরহ। সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে অসংখ্য ফেনসিডিল কারখানার তথ্য গয়েন্দা সংস্থা ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরোকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েও কোনো সুফল মিলছে না। এগুলো ধ্বংস করতে দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার চিঠি চালাচালি হয়েছে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এমনকি সীমান্তের পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রেড অ্যালার্ট জারি, অভিজ্ঞতা বিনিময়, মাদক কারখানা ধ্বংস, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, যৌথ কমিটি গঠন এবং পরিদর্শন পদ্ধতি চালুর মতো কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরও মাদক আসা বন্ধ হচ্ছে না। অথচ বিস্ময়কর তথ্য হলো, ইয়াবা-আইসের মতো মারাত্মক মাদকদ্রব্য তৈরির একটি কারখানও দেশে নেই। সব কারখানাই সীমান্তের ওপারে স্থাপিত। সহযোগী পত্রিকায় প্রকাশ, মিয়ানমারের সীমান্তে প্রায় ১৪০টি ইয়াবা কারখানা ও ভারত সীমানেত ৭০ এর অধীক ফেনসিডিল কারখানা রয়েছে। বাংলাদেশে পাচারের জন্যই কারখানাগুলোতে ইয়াবা তৈরি করা হয়। ভারত সীমান্ত পেরিয়ে মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য অবৈধপথে ভারত থেকে দেশে প্রবেশের সময় বিজিবির অভিযানে আটকের ঘটনা ঘটে অহরহ। বিজিবি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, মিয়ানামার ছাড়া ভারতেও ইয়াবা তৈরি হচ্ছে- যার লক্ষ্য বাংলাদেশের বাজার। তারা বলেন, ইয়াবা তৈরির উপকরণ অ্যামফিটামিন, মেটাফিটামিন ও সিউডোফিড্রিন ভারতের বাজারে সহজলভ্য এবং এসব ক্রয়ে কাউকে ঝামেলা পোহাতে হয় না। ফলে ভারতেও যে ইয়াবা তৈরি হয়ে বাংলাদেশে আসছে তা কমবেশি নিশ্চিত সংশ্লিষ্টরা। গয়েন্দা সংস্থার হিসাবমতে সীমান্ত হয়ে প্রতি বছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব মাদক দ্রব্য সেবন করের ধংসের পথে যাচ্ছে বাংলাদেশের গোটা সমাজ ব্যবস্থা। গয়েন্দা সংস্থার তথ্র মতে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় পপি চাষ হচ্ছে। পপির বীজ থেকে আফিম, মরফিন, হেরোইনের মতোই পাওয়া যায় কোডিন। কোডিনই ফেনসিডিল তৈরির মূল উপাদান। তাই খুব সহজেই কাঁচামাল সংগ্রহ করে ফেনসিডিল তৈরি করা হচ্ছে। পরে পৌঁছে দেওয়া হয় সীমান্তের এপারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দশ বছরে মাদক কারবারি ও ফেনসিডিল কারখানার তালিকা নিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। দুই দেশের মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে যৌথ অভিযানেরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এর ইতিবাচক ফল দেখা যায়নি। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়েও বৈঠক হয়েছে বেশ কয়েকটি। ওইসব বৈঠকে সাতক্ষীরা,খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১ হাজার ১৬২ কিলোমিটার সীমান্তে গড়ে ওঠা ফেনসিডিল ও হেরোইন তৈরি এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার তালিকা বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এসময় অন্তত ২২টি ফেনসিডিল কারখানা ধ্বংসও করেছিল ভারত। এর পরও মাদকদ্রব্য আসা বন্ধ হচ্ছে না।
ভারত সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা। জেলায় ২৩৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভারতীয় সীমান্ত। সুন্দরবনের মধ্যে ১০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জল সীমানা বেষ্টিত আর ১৩৮ কিলোমিটার রয়েছে স্থল ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা। এসব ভারতীয় সীমানা দিয়ে চোরাইপথে মাদক ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। বৃহস্পতিবার ৮ সেপ্টেম্বও ২০২৩ সকাল ১০টায় সাতক্ষীরা নীলডুমুরস্থ ১৭ বিজিবি’র অধিনায়ক লে: কর্নেল মোহাম্মদ কামরুল আহসানের নেতৃত্বে বিপুল পরিমাণে মাদকদ্রব্য ধ্বংশ করা হয়। বিগত সেপ্টেম্বর ২০২০ হতে জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত সীমান্ত হতে মালিকবিহীন অবস্থায় এসব মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়। ধ্বংশকৃত মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার মদ ২ হাজার ৭৪ বোতল, ফেন্সিডিল ৯, হাজার ৬২১ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ৭২ হাজার ৪৬৮ পিস, গাঁজা ১২ কেজি ৪০০ গ্রাম, বিভিন্ন প্রকার ভারতীয় নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ১ লাখ ৪ হাজার ১২ পিস, বাংলা মদ ২ লিটার, বিয়ার ১ বোতল, তামাক ১০০ গ্রাম, ভারতীয় পাতার বিড়ি ৬৫ হাজার ৭৬৯ প্যাকেট, ভারতীয় বিড়ির পাতা ১ কেজি ৮০০ গ্রাম, ভারতীয় বøাক হুইসকি ৬ প্যাকেট। আটককৃত মাদকদ্রব্য ধ্বংশ কার্যক্রমের সময় আরো উপস্থিত ছিলেন কালিগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আমিনুর রহমান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা পরিচালক মো: তাজুল ইসলামসহ অনেকে। এর আগে বিজিবি জানায়, বিগত ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাই পথে আসা মালিকবিহীন এ সব মাদকদ্রব্য বিজিবি কর্তৃক জব্দ করা হয়। এক কোটি ৯১ লাখ ৫৮ হাজার ৮’শ টাকা মুল্যের উক্ত মাদকদ্রব্য ধ্বংস করা হয়। ধ্বংসকৃত মাদকদ্রব্যের মধ্যে ছিল, ১৭ হাজার ৩০০ বোতল ভারতীয় ফেন্সিডিল, ১ হাজার ৩৯৫ বোতল বিভিন্ন প্রকার মদ, দুই’ শ ৫৭ কেজি গাঁজা, ২২ হাজার ৬৪৮ পিস ইয়াবা, ৭ হাজার ৬৩৮ পিস বিভিন্ন প্রকার নেশা জাতীয় ট্যাবলেট এবং দুই হাজার প্যাকেট বিড়ি, সিগারেটসহ অন্যান্য তামাক জাতীয় দ্রব্য।
আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদকসেবী জানান, প্রশাসনের এত অভিযানের পরও টাকা হলে ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সাতক্ষীরা শহরেরই পাওয়া যায়। তবে শহরের মধ্যে একটু দাম বেশি নেয়। সীমান্ত এলাকায় গেলে কম দামে পাওয়া যায়। শহরের মধ্যে প্রতি পিস ফেনসিডিল পাওয়া যায় ৮০০-৯০০ টাকায়। ভোমরা সীমান্ত এলাকায় পাওয়া যায় ৫০০ টাকায়।
সাতক্ষীরা নীলডুমুর ১৭ বিজিবি’র অধিনায়ক লে: কর্নেল মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিজিবি এর মহাপরিচালক এর নির্দেশনা অনুযায়ী নীলডুমুর ব্যাটালিয়নের সৈনিকগণ মাদক চোরাচালান দমনে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বিজিবির টহল জোরদার রয়েছে। বিজিবির অভিযানে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার হচ্ছে। এছাড়া অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ভারতীয় পণ্যও উদ্ধার করা হচ্ছে। চোরাচালানিরা সক্রিয় হলেও সীমান্ত এলাকায় তৎপর রয়েছে বিজিবি।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, ‘দেশ থেকে মাদক নির্মূল করতে যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। মাদক কারবারিদের নিশ্চিহ্ন করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একের পর এক অভিযান চালাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে আমরা একাধিকবার বৈঠক করেছি। তারাও আমাদের সহায়তা করছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে থাকা ফেনসিডিল তৈরির কারখানাগুলো ধ্বংস বা বন্ধ করে দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।