আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ মানুষের ক্রম আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন ও দখলের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের অস্তিত্ব। প্রতিবছর ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবন থেকে কমতে কমতে এখন এক তৃতীয়াংশে দাঁড়িয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বল হয়ে পড়ছে। দুর্বল হয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বৃহত্তর খুলনা (খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা) জেলার গেজেটিয়ারে বলা হয়েছিল, নির্বিচার বনসম্পদ লুট ও প্রাণী হত্যা বন্ধ না হলে সুন্দরবন বিবর্ণ, বৃক্ষলতাহীন, প্রাণহীন হয়ে পড়বে। পাঁচ দশক পর পরিস্থিতি ততটা মারাত্মক না হলেও সুন্দরবনের প্রাণপ্রাচুর্য কমছে। গবেষকেরা বলছেন, সুন্দরবনের কিছু গাছ, প্রাণী ও পাখি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। তিন বছর আগে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের আয়তন কমে আসার কিছু তথ্য প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯০৪-২৪ সালে দুই দেশের সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১১ হাজার ৯০৪ বর্গকিলোমিটার। ১৯৬৭ সালে তা কমে হয় ১১ হাজার ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০০১ সালে আয়তন কমে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫০৬ বর্গকিলোমিটারে। ২০১৫-১৬ সালে আয়তন ছিল ১১ হাজার ৪৫৩ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন ৪৫১ বর্গকিলোমিটার কমে গেছে।
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে এর চারপাশ ঘিরে ভারী শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কেনার হিড়িক পড়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০০ শিল্পগোষ্ঠী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আশপাশ গ্রামগুলোতে প্রায় ১০ হাজার একর জমি কিনেছেন। সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিবেশ অধিদফতর এই এলাকাতেই ১৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রæপ। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতা ও সমর্থক ব্যবসায়ী ওই এলাকায় নামে-বেনামে জমি কিনেছেন। মোংলা উপজেলায় ১২টি, বাগেরহাটের শরণখোলায় ১ ও মোরেলগঞ্জ ২, সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ৮, খুলনার কয়রায় ৪৯ ও দাকোপে ৩৩টি প্রকল্পকে পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি গবেষণা সংস্থা সিজিআইএসের গবেষণায় দেখিয়েছিলেন, সুন্দরবনের আয়তন কমছে, জলাভূমি বাড়ছে। সংস্থাটির মতে বনাঞ্চলে ঘুরে এবং উপগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে ২৭ বছরে ৭৬ বর্গকিলোমিটার জমি কমেছে সুন্দরবনের। তবে বনের জমি কমে আসার বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না বন বিভাগ। বন বিভাগ বলছে, বনের আয়তন কমছে কি না, সে বিষয়ে সহমত বা দ্বিমত পোষণ করা যায় না। সুন্দরবনের ভেতরে নদীভাঙন স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বনের মধ্যে কোথাও বড় কোনো অঞ্চল নদীতে বিলীন হয়েছে কি না, তা মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়নি।
পরিবেশ ও জৈব সম্পদের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, সুন্দরবনে ১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে ২৯৬টি গাছ ছিল। গাছের সংখ্যা নিয়মিতভাবে কমে ১৯৮৩ সালে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮০-তে। ১৯৯৬ সালে তা আরও কমে হয় ১৪৪। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে গাছের সংখ্যা নেমে আসবে হেক্টরপ্রতি ৮০টিতে। সিইজিআইএসের গবেষণায় ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের আয়তন ৫ হাজার ১২৪ বর্গকিলোমিটার কমেছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, গত ২৭ বছরে ভারতীয় অংশে ভূমির আয়তন কমেছে ৬২ বর্গকিলোমিটার এবং জলাভূমির আয়তন ৫৮ কিলোমিটার বেড়েছে। গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের আয়তন যা বলা হয়, বাস্তবে তার চেয়ে কম।
ভূতত্ত¡বিদরা বলছেন, বাংলাদেশের কিছু এলাকাসহ সুন্দরবন হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ‘অ্যাকটিভ ডেলটা’ অঞ্চলে। অর্থাৎ এই বদ্বীপ এলাকায় ভূগঠনপ্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এই অঞ্চলের ভূমি এখনো ভাঙা-গড়ার মধ্যে আছে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে সুন্দরবনে ঘন বন ছিল ৬৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা কমে হয় ৩৮ শতাংশ। গবেষণায় বন দুর্বল হওয়ার আরও নানা তথ্য আছে।
নানা কারণে ধীরে ধীরে এবন ছোট হয়ে আসলেও বাংলার অহংকার সুন্দরবনের বাংলাদেশ ও ভারত এ দুই দেশের অংশেই বাইরে থেকে বা পাখির চোখে উপর থেকে দেখলে সুন্দরবনের দৃশ্য এখনও নয়নাভিরাম। এর ভিতর দিয়ে বহমান নদী থেকে সুন্দরবনের দিকে তাকালে মনে হবে যেন সুসজ্জিত এক বাগান। কিন্তু এর ভিতরটায় প্রতিনিয়ত সৌন্দর্য ও সম্পদহানি ঘটছে।