আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জাহাজ ডুবির পাশা পাশি সুন্দরবনে বার বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে । গত দুই দশকে সুন্দরবনে অন্তত ২৩টি বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনার ঘটেছে। এসব অগ্নিকান্ডে কমপক্ষে ৭১ একর বনভ‚মি বিলোপ হয়েছে। এসব অগ্নিকান্ডের বেশিরভাগই মানব সৃষ্ট বা ইচ্ছাকৃত নাশকতা বলে রিপোটে দাবী করা হয়েছে। একের পর এক কেন অগ্নিকান্ডের ঘটনাও ঘটছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ এ বনে। বিগত সময়ে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় তদন্ত রিপোর্টে জেলে ও বনজীবীদের দায়ী করা হলেও তাদের চিহ্নিত করা বা জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো নজির নেই। এমনকি অনেক সময় বনের অসাধু কর্তাব্যক্তিরাও জড়িত থাকেন। এসব অসাধু কর্তাব্যক্তিরা কাঠ, হরিণ ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণী পাচারকারীরা, দেশি ও আর্ন্তজাতিক চোরাকারবারীদের পণ্যের নিরাপদ রুট ব্যবহারের জন্য অন্যত্র দৃষ্টি ফেরাতে পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনে আগুন লাগিয়ে দেয়। আবার অনেকেরই ধারণা সুন্দরবনের মাটির নিচে থাকা গ্যাস থেকে কখনও কখনও অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। বনের মধ্যে পচাপাতা থেকে তৈরি হওয়া মিথেন গ্যাসের স্তর জমে বনজীবীদের ফেলা বিড়ি-সিগারেট থেকেও আগুনের সূত্রপাত হয়। মৌয়ালরা মধু আহরণ করতে বনে আসেন। চাক ভাঙার সময় তারা আগুন ব্যবহার করেন। সেখান থেকেও বনে আগুন ছড়িয়ে থাকতে পারে। তবে বন কর্মকর্তারা বলছেন, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ থেকেই অধিকাংশ সময় সুন্দরবনে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। কেননা সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা এ বনের ওপর নির্ভরশীল। তারা বনের ভেতর প্রবেশ করলে অনেকেই শুকনো ডালপালা কিংবা গোলপাতার উপর বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ ফেলেন।
সুন্দরববন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সালে শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্য এলাকায়, ২০০৪ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্প এলাকায় এবং আড়ুয়াবের খালে, ২০০৫ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের আড়ুয়াবের খালের পশ্চিমে তুলাতলা ও খুটাবাড়ি এলাকায় আগুন লাগে। ২০০৬ সালেই তেরাবেকা খালের পাড়ে, আমুরবুনিয়া, কলমতেজিয়া, পচাকুড়ালিয়া বিল ও ধানসাগর স্টেশন এলাকায় মোট পাঁচটি অগ্নিকা- ঘটে। ২০০৭ সালে বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী নলবন, পচাকুড়ালিয়া বিলে, ২০১০ সালে ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী, ২০১১ সালে ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, ২০১৪ সালে আবারও ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন বনে অগ্নিকা- ঘটে। ২০১৬ সালেও ধানসাগর স্টেশনের নাংলী, পচাকুড়ালিয়া, তুলাতলী এবং ২০১৭ সালে একই স্টেশনের মাদরাসার ছিলা নামক স্থানে আগুন লাগে। ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানগারস স্টেশন এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৪ শতক বনভূমি পুড়ে যায় । এর দুই মাসের মাথায় ৩ মে শরণখোলার দাসের ভারনী এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটল। বন বিভাগের হিসেব মতে, গত ২০ বারের অগ্নিকান্ডে সুন্দরবনের ৭১ একর ৭০ শতাংশ বনভূমির গাছ, বিভিন্ন প্রকার ঘাস, লতাপাতা পুড়ে যায়। এদিকে গোটা সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জের মধ্যে কেন শুধুমাত্র চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় একের পর এক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে— এ নিয়ে নানা প্রশ্ন অনেকের। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে নারাজ পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বনবিভাগের দাবী সুন্দরবন লাগোয়া ঘনবসতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জন্য এখন হুমকি। সুন্দরবনকে যে সকল অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে তার অধিকাংশ ঘটনার সাথে ওই জনবসতিদের কারো না কারো সম্পৃক্ততা থাকে। জনবল সংকটের কারনে নিরন্তত চেষ্টা করেও অপরাধী চক্রের লাগাম টানতে পারছেনা বনবিভাগ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনের নানা সম্পদ লুটতে প্রভাবশালী চক্র বনসংলগ্ন এলাকার জনবসতিদের মধ্যে কিছু অসাধু ব্যক্তিকে প্রলোভন দেখিয়ে বনের অভ্যন্তরে পাঠিয়ে অপরাধমুলক কর্মকান্ড করতে বাধ্য করে।
অগ্নিকা- এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ তিনটি হচ্ছে, সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন, অগ্নিকা- প্রবণ এলাকায় প্রতি ২ কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোল ঘেঁষে বনের পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা রশির নেট দিয়ে বেড়া দেয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনটির একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। পূর্ব সুন্দরবনের অরণ্যে গত ১৪ বছরে সরকারি-বেসরকারি হিসাবে ১৮টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলেও এর প্রতিকার ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে চিহ্নিত করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বার বার পুড়ছে সৌন্দর্য্যর লীলাভূমি সুন্দরবন।
বাংলাদেশের পরিবেশগত ও ভূ-সগংশ্লিষ্টরা বলছেন,সুন্দরবনের নিরাপত্তা মানে বাংলাদেশের নিরাপত্তা। এ নিয়ে হেলাফেলার কোনো সুযোগ নেই। গত দুই দশকে অগ্নিকান্ড, গাছচুরি ও দখলবাজিতে সুন্দরবনের যে সব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে সব এলাকায় পরিকল্পিত বৃক্ষরোপন ও সংরক্ষনের মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা নিতে হবে। নাশকতা ও দখলবাজির সাথে জড়িত স্থানীয় জেলে, বনদস্যু ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে জড়িতদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। অগ্নিকান্ডসহ নাশকতা রোধ ও বনজসম্পদ রক্ষায় সুন্দরবনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অবজারভেটরি টাওয়ার স্থাপনসহ নিরাপত্তা টহল বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন,বলেন, সুন্দরবনে বিভিন্ন সময় নানা কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে অগ্নিকান্ডের ঘটনার জন্য প্রাথমিকভাবে বিড়ি অথবা সিগারেটের জ্বলন্ত অংশকেই দায়ী করা হচ্ছে। তিনি জানান, সুন্দরবনের যে অংশে বেশি বার আগুন লেগেছে তা লোকালয়ের পাশে। অনেকে গরু-ছাগল বনের ভেতর ছেড়ে দেন। যা খুঁজতে বনে প্রবেশ করার সময় অনেকে বিড়ি-সিগারেট নিয়ে ঢোকেন। এ থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা বেশি ঘটে। তবে সুন্দরবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা যে ভাবেই ঘটুক না কেন তার সুষ্ঠু তদন্ত, অগ্নিকান্ডের কারণ ও জড়িতদের চিহ্নিত কওে আমরা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মতো বনফায়ার সুন্দরবনে হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা এখানের আবহাওয়া আদ্র। যে কারণেই সুন্দরবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটুক না কেন তার সুষ্ঠু তদন্ত, অগ্নিকান্ডের কারণ ও জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কমবে।