আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ জেলার স্থায়ী বাজার ছাপিয়ে ঘেরের আইলের নজরকাড়া সবজি এখন অস্থায়ী ভ্রাম্যমাণ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ ট্রাক সবজি যাচ্ছে রাজধানি ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে। জেলার প্রধান প্রধান সড়কের দুধারে গড়ে উঠেছে একাধিক ভ্রাম্যমাণ সবজির বাজার। মাত্র ২ মাসের জন্য গড়ে ওঠা এ বাজার এখন জমজমাট। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত চাষিরা সরাসরি তাদের সবজি এ বাজারে বিক্রি করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কাঁচা মালের পাইকারী ক্রেতারা কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি সবজি ক্রয় করেন। পদ্মা সেতু চালুর পর সাতক্ষীরায় উৎপাদিত সবজির বড় একটি অংশ ক্ষেত থেকে এখন সরাসরি ঢাকায় যাচ্ছে।কৃষিস¤প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বিগত কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাছের ঘেরের পাড়ে সবজি চাষ। ‘সাথী ফসল’ হিসেবে শুরুহলেও এখন মূল ফসলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে সমানে সমান। মাচায় বা ঘেরের আইলে সবজি আর নিচের পানিতে মাছ চাষ হচ্ছে। জেলায় প্রতি বছর যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ঘেরের আইলে মাচা পদ্ধতিতে। ঘেরের আইলে সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় জেলার অধিকাংশ মৎস্য ঘেরে সবজির চাষাবাদ দিন-দিন বাড়ছে। তবে সবজি ক্রয় বিক্রয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যসহ একটি প্রভাবশালি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সবজির দাম ওঠা নামা সেই সিন্ডিকেটের হাতে। ফলে জেলাতে সবজি উৎপাদনের ভরা মৌসুমে কৃষকগণ তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। অপরদিকে বিভিন্ন কলাকৌশল ব্যবহারের ফলে নিরাপদ সবজি উৎপাদন হলেও পৃথক বাজার ব্যবস্থা না থাকার কারণে কৃষকগণ নিরাপদ সবজির সঠিক মূল্য হতে বঞ্চিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে ভোক্তাগণও নিরাপদ সবজি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
জেলাতে আশির দশক থেকেই পানি ও মাটিতে লবণাক্ততার তীর্ব্রতা বাড়তে থাকায় ধানের উৎপাদন কমতে থাকে। জমির মালিকরা ঝুঁকে পড়েন চিংড়ি, বিশেষ করে, বাগদা চাষে। শুরুতে চিংড়ি চাষে লাভবান হলেও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে চিংড়ির উৎপাদন। এখন চিংড়িঘেরগুলোতে মাছ নেই, নেই ধানের উৎপাদনও। তাই এ অবস্থায় বিকল্প পেশা ও কর্মসংস্থানের উপায় খুঁজতে চিংড়ি ঘেরের ভেড়ি ও পতিত জমিতে মৌসুমি সবজি চাষে আশার আলো দেখছেন অনেকে। এতে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি বিক্রি করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করছেন চাষিরা। আশি^ন কার্তিকের মান্দার সময় সবজি চাষে অনেকের ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে । আর্থিকভাবে লাভবান হওয়াসহ ফিরেছে সচ্ছলতাও।
বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ কৃষি কাজের সাথে জড়িত এবং মোট শ্রম শক্তির শতকরা ৬০ ভাগ যোগান দেয় কৃষি খাত। প্রচুর শাকসবজি উৎপাদিত হয় এবং বিশ্বে শাকসবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। কিন্তু এসব শাকসবজির উৎপাদনে নিরাপদতা নিশ্চিত না হওয়ায় তা দেশের সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। অন্যদিকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে বিপণন পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি নষ্ট হচ্ছে, যা প্রায় শতকরা ২৫-৩০ ভাগ। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৬% এবং দেশের প্রায় ৪৫% লোক কৃষি কাজের সাথে নিয়োজিত। সংশ্লিষ্টদের দাবী উৎপাদন পর্যায়ে কৃষকদেরকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হলে বিষমুক্ত নিরাপদ শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে আগ্রহী করতে হবে ।
সাতক্ষীরা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলার ৮৭৫ হেক্টর জমির (মৎস্য ঘেরের বেড়ি) আইলে বিভিন্ন প্রকারের সবজি চাষ হয়েছে। এরমধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৩৪০ হেক্টর, তালায় ১৬৫ হেক্টর, কলারোয়ার ৫৫ হেক্টর, আশাশুনি ৮০ হেক্টর, কালিগঞ্জে ১৩৫ হেক্টর,দেবহাটায় ২০ হেক্টর, ও শ্যামনগর উপজেলায় ৮০ হেক্টর জমির আইলে সবজির চাষ হয়েছে। এসব জমি থেকে হেক্টর প্রতি গড় ১৯ মেট্রিকটন হারে মোট ১৬ হাজার ৬২৫ টন সবজি উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এর চেয়ে বেশি উৎপাদন হতে পারে বলে তারা জানান।
সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়ক সংলগ্ন তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের মিঠাবাড়ি বিলে শত-শত বিঘা জমির মৎস্য ঘেরে মাচা পদ্ধতিতে লাউ, কুমড়া ও করলার চাষাবাদ করা হয়েছে। মাচায় ঝুলছে হাজার-হাজার করলা, শতশত লাউ ও কুমড়া। একই সাথে ঘেরের পাড়ে লাগানো হয়েছে পুঁইশাক ও ঢেঁড়স। প্রতিদিন সাতক্ষীরা খুলনা মহাসড়কে ভ্যাম্যমাণ সবজির বাজার বসছে। একই ভাবে সাতক্ষীরা যশোর-মহাসকের লাবসা পলিটেকনিক মোড়ে অস্থায়ী সবজির বাজার বসেছে। প্রতিদিন সদরের আগরদাড়ি ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকা থেকে এখানে সবজি বিক্রয় করা হয়। ৪০ জন পাইকারী ব্যবসায়ী এই বাজার থেকে সবজি ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে। আব্দুল্লাহ, লালটু, আনছারসহ কয়েকজন পাইকারী ব্যবসায়ির সাথে কথা হয়। তারা জানান, মাত্র ২ মাসের জন্য এখান থেকে আমরা সবজি কিনতে পারবো। তার পর আর ঘেরে সবজি থাকে না। তখন আমরা অন্য এলাকাতে যেয়ে পটলের ব্যবসা করবো। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকাতে আমরা সারা বছরই সবজির ব্যবসা করে থাকি। এতে স্থানীয় চাষিরা ভাল দাম পেয়ে থাকে। গতকাল তারা ৪ ট্রাক খিরাই, বরবটি,উচ্ছেসহ বিভিন্ন কাঁচা সবজি ক্রয় ঢাকাতে পাঠিয়েছে। তবে এধরণে বাজার ব্যবস্থায় বাজার মনিটারিং এর কোন ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন ধরণের হয়রানির শিকার হয় চাষিরা বলে অভিযোগ রয়েছে।
জেলাতে চাষকৃত প্রচলিত অপচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি যার মধ্যে ৩০-৩৫টিকে প্রধান সবজি ধরা যায়। শতকরা ৯.৩৮ ভাগ জমি সবজি চাষের জন্য ব্যবহার হচ্ছে যার মাধ্যমে মাথাপিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য প্রতিদিন ২২০ গ্রাম সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্যতালিকায় জেলায় সবজির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। একই সাথে সবজি চাষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এ ছাড়াও পোকামাকড় দমন ও রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য নানারকম বালাইনাশক ব্যবহার করা হয়। সঠিক মাত্রার যথাযথ ব্যবহার না করা এবং উপযুক্ত বালাইনাশক ব্যবহার না করার দরুন অনেক ক্ষেত্রে সবজি আর নিরাপদ থাকছে না। অনিরাপদ সবজি পুষ্টির পরিবর্তে মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে এবং দেশের বাইরে রপ্তানি ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করছে। এতে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে সাতক্ষীরা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, ঘেরের বেড়িতে শাক-সবজি আবাদে সাতক্ষীরা জেলা মডেল হয়ে উঠেছে। চলতি মৌসুমে জেলার ৮৭৫ হেক্টর জমির ঘেরের বেড়িতে ১৬ হাজার ৬২৫ টন শাক-সবজি উৎপাদন হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এতে খামারিদের যেমন আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি জেলাবাসীর পুষ্টির চাহিদাও মিটছে।
Check Also
আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি
এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …