আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ আশানুরূপ মূল্য না পাওয়ায় পাট চাষিরা লোকসানের মুখে পড়ছেন। পাটের এমন দরপতনে চাষিদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। পাটের দরপতনের কারণ দেখিয়ে অধিকাংশ ব্যবসায়ী পাট কিনছেন না। আর যাঁরা কিনছেন, তাঁদের কাছে কম দরেই চাষিরা পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। চরম বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা পাটের দাম কমানোর জন্য অজুহাত খোঁজে। সামান্য বৃষ্টি বা হাঁটে পাটের আমদানি বেশি হলে সিন্ডিকেট করে পাট ক্রয় করে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বাজার ব্যবস্থা অনুযায়ী দাম দিয়ে পাট ক্রয় করা হচ্ছে। বেশি দাম দিয়ে কিনলে বড় বড় আড়তদাররা বেশি দাম দিতে চায় না। বাধ্য হয়ে এমন দামে কিনতে হয় তাদের। অভিযোগ কৃষকদেও অভিযোগ বর্তমানে পাটের বাজার সিন্ডিকেটের দখলে চলেগেছে।
বর্গাচাষিরা বলছে তাদের পাট চাষে প্রতি বিঘায় সাত থেকে আট হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। এখন হতাশাগ্রস্ত কৃষকরা আগামিতে পাট আবাদে অনিহা প্রকাশ করছে। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বৈশ্বিক মন্দায় বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের চাহিদা কিছুটা কমেছে। এ কারণে বাংলাদেশেও পাটের দাম কিছুটা কম। দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাতের ওপর নিভর্রশীল। প্রত্যেকই ক্ষতিগ্রস্তের মুখে। যে কারণে পাটের ন্যায্য দাম দিতে প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র বলছে, বর্তমান বিশ্বে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের বৃহদাংশই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে- যা মোট বিশ্ব বাজারের প্রায় ৬৫ শতাংশ। একমাত্র বাংলাদেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের পাট উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় তিন শতাংশ পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপিতে এর অবদান প্রায় শতকরা তিন ভাগ। প্রতি বছর প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা কৃষক পেয়ে থাকে পাটের আঁশ ও পাটখড়ি বিক্রি করে। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস হিসেবে পরিণত হচ্ছে। যে কারণে পাট খাতের উন্নয়নের জন্য পাট ও পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ বা বর্ষপণ্য এবং পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে গণ্য করার সানুগ্রহ ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাট এখন থেকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হবে। পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গৃহীত হয়েছে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ।
সংশ্লিষ্টরা বলছে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে আবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সারা বিশ্বে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ফলত পাটপণ্যের বাজারই সৃষ্টি হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়নের। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও বাংলাদেশের দেশের উন্নতমানের পাট এ দুই হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বিঘা জমি পাট চাষের জন্য উপযোগী করতে ১ হাজার ৮০০ টাকা খরচ হয়। তিনবারে নিড়ানির জন্য খরচ হয় ৩ হাজার ৫০০ টাকা, বীজ খরচ ৩০০ টাকা, সার ও কীটনাশক ৫ হাজার টাকা, সেচ ৮০০ টাকা, কাটা ৬ হাজার টাকা এবং ধোয়া ও শুকানো ৪ হাজার ৭৫০ টাকা। সব মিলিয়ে এক বিঘা জমি চাষ করতে খরচ হয় ২২ হাজার ১৫০ টাকা। বিঘাপ্রতি তুষা জাতের পাট উৎপাদন হয় ১০ মণ আর দেশি পাট উৎপাদন হয় ৯ মণ। সেই হিসাবে ১০ মণ পাট বিক্রি হয় ১৮ হাজার টাকায়। পাশাপাশি এক বিঘা জমির পাটখড়ি বিক্রি করা যাচ্ছে আড়াই হাজার টাকায়।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলার সাতটি উপজেলায় ১১ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে দেশি জাতের পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২০ হেক্টর জমিতে আর তুষা জাতের পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ১১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। সেখানে আবাদ হয়েছে ১১ হাজার ৮৫৩ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে দেশি জাতের পাট আবাদ হয়েছে ৮২ হেক্টর জমিতে আর তুষা জাতের পাট আবাদ হয়েছে ১১ হাজার ৭৭১ হেক্টর জমিতে। সব মিলিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চলতি মৌসুমে ২৩৩ হেক্টর বেশি জমিতে পাট চাষ হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সফিকুল ইসলাম জানান, পাট উৎপাদনের পরপরই সব কৃষক একসঙ্গে পাট বাজারে নিয়ে গেলে আড়তদারেরা তাঁদের ইচ্ছেমতো মূল্য দেন। যদি কিছুদিন রেখে কৃষক বিক্রি করেন, সে ক্ষেত্রে দাম ভালো পাওয়া যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ হলে কৃষকেরা লোকসানে পড়ত না।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাট চাষের উন্নয়ন ও পাট আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এর আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। পণ্য বৈচিত্র্যকরণে সরকারি পাটকলগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন এবং উৎপাদন স্থিতিশীল রাখার জন্য পাটের ন্যূনতম বাজারমূল্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও মাটি পাট উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে। এ খাতে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে এবং ছোট কারখানাগুলোকে সমবায়ের মাধ্যমে বড় আকারের উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে।