ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের শরয়ী বিধান

বিলাল হোসেন মাহিনী:মূল আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে ভূমিকায় কিছু কথা বলে রাখা দরকার। গান গাওয়া বা শোনার বিধান কী? গান জায়েজ নাকি নাজায়েজ? এই প্রশ্নের উত্তর কি মুফতি-মওলানা বা ইসলামি স্কলারগণ এক কথায় দিতে পারবেন? অথবা গোস্ত খাওয়ার বিধান কী? এই প্রশ্নের উত্তরও কেহ এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। কেননা, গানের কথা ও গায়কের ওপর নির্ভর করে গান জায়েজ নাকি না নাজায়েজ। তেমনি গোস্ত কোন পশুর এবং জবেহ’র ক্ষেত্রে শরয়ী নির্দেশনা মানা হয়েছে কি-না, তার ওপর নির্ভর করে গোস্ত জায়েজ নাকি নাজায়েজ। ঠিক, এ কারণেই এক কথায় বলে দেওয়া যাবে না যে, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন করা সহীহ নাকি বাতিল। কেননা, এক দিকে নবী (সা.) বলেছেন, (দীনের মধ্যে, ইবাদত মনে করে) নবউদ্ভাবিত প্রত্যেকটি বিষয়ই বিদয়াত এবং প্রত্যেক বিদায়াতই ভ্রষ্টতা আর সকল ভ্রষ্টতা জাহান্নামের পথ দেখায়। (সুনান নাসায়ি, হাদীস-১৫৭৮)। অন্যদিকে তিনি (সা.) বলেছেন, সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী (সা.) তাঁর জন্মদিন পালন করতেন সাপ্তাহিকভাবে এবং তা করতেন সোমবার রোজা পালনের মাধ্যমে। হযরত আবু কাতাদাহ (রা.) বলেন, নবিজিকে তাঁর সোমবার সিয়াম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন, এদিন আমি জন্মলাভ করেছি (সহীহ মুসলিম, হাদিস- ১১৬২)। সুতরাং উপরোক্ত দৃষ্টান্ত থেকে এ কথা বলা যায় যে, সুন্নাহ’র অনুসরণে নবিজি (সা.) এর জন্মদিন তথা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনে মুসলিম উম্মাহ একদিকে সওয়াবের অধিকারী হবেন, অন্যদিকে রাসুলের (সা.) সীরাত (আদর্শ জীবনী) বিশ্ববাসী জানতে পারবে। বিশ্বনবীর (সা.) উন্নত ও মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে বহু অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আসবে, শান্তি ও নিরাপত্তা বেষ্টনিতে ভরপুর হয়ে যাবে গোটা দুনিয়া। (ইন-শা-আল্লাহ)

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) : মিলাদ  শব্দের অর্থ জন্ম বা জন্মদিবস। ‘মিলাদুন্নবী’ বলতে আমরা বুঝি, আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্ম বা জন্মদিবস। আমাদের মুসলিম সমাজে বিভিন্নভাবে মিলাদুন্নবী পালন করা হয়ে থাকে। মিলাদুন্নবী বা নবিজির জন্মদিন কেন্দ্রিক এসব উৎসবকে বলা হয় ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’। যদিও হাদীস ও সুন্নাহয় মুসলিম জাতির জন্য শুধু দু’টি ঈদের কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা (সুনান আবু দাউদ, হাদীস-১১৩৪; সুনান নাসায়ি, হাদীস-১৫৫৬; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস-১২৮২৭)।

বিশ্বনবী’র (সা.) জন্মদিনের আমল : সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী সা. তাঁর জন্মদিন পালন করতেন সাপ্তাহিকভাবে এবং তা করতেন সোমবার রোজা পালনের মাধ্যমে। সাহাবায়ে কেরামগণও সোমবারের আমল করেছেন, উৎসাহিত করেছেন। অধিকিন্তু, বিগত কয়েক শতাব্দি ধরে মুললিমদের একটি বিরাট অংশ সুন্নাহ’র অনুসরণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বহু বিদয়াতি আমলের মাধ্যমে দিনটি পালন করে আসছে। যার ফলে সাধারণ মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। বিদয়াতিরা নিজেদের নব উদ্ভাবিত আমল (মিলাদুন্নবী’তে বার্ষিক মিলাম মাহফিল, আতশবাজি, পটকা ফোটানো, জলসা-জুলুস, খিচুড়ি-জিলাপি বিতরণ)-কে নবিজির শানে মহব্বত বলে মনে করেন। তারা বলেন, এগুলো তো ‘নবিজি করেননি, নিষেধও তো করেননি।’ অথচ, বিদআতের পরিচিতি ও পরিণতি খুবই ভয়াবহ। নবিজি (সা.) বলেছেন, (দীনের মধ্যে) নবউদ্ভাবিত প্রত্যেকটি বিষয়ই বিদায়াত এবং প্রত্যেক বিদায়াতই ভ্রষ্টতা আর সকল ভ্রষ্টতা জাহান্নামে (সুনান নাসায়ি, হাদীস-১৫৭৮)। সুতরাং, রাসুলের (সা.) শানে মহব্বতের নামে সুন্নাহ’র খেলাপ হলে তা পরিতাজ্য হবে।

দেখুন, খ্রিস্টানরা তাদের নবির জন্মদিন পালন করে ২৫ ডিসেম্বর। কিন্তু তাদের ধর্মগ্রন্থে যেমন নবির জন্মদিন পালনের কোনো নির্দেশনা নেই, তেমনি ঈসা আ. এর জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর প্রমাণিত নয়। তাদের অনুকরণ করতে গিয়ে আমাদের অবস্থাও তাদের মতোই হয়ে গেছে। শরীয়তের নির্দেশনা ছাড়াই নতুন এক ইবাদতের উদ্ভাবন করেছি আমরা। অথচ নবি (সা.) ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিধর্মীদের অনুসরণ করতে বারবার বহুভাবে আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা সর্বতভাবে তাদের (আহলে কিতাব, ইয়াহুদি-খ্রিস্টান, মুশরিক, মূর্তিপূজক, অগ্নিপূজক) বিরুদ্ধাচারণ করো (সহীহ বুখারি, হাদিস-৫৮৯২; সহীহ মুসলিম)
মিলাদুন্নবী পালন যেসব কারণে পরিত্যাজ্য : ক) এটি রাসূলুল্লাহ(সা:) কিংবা তাঁর খলীফাদের সুন্নাত ছিল না। ফলে এটি একটি নিষিদ্ধ নব উদ্ভাবন বৈ কিছুই নয়। খ) মিলাদুন্নবী উদযাপনের দ্বারা খ্রিস্টানদের অনুসরণ করা হয়, কেননা তারা মসীহের(আঃ) জন্মদিন পালন করে।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের পথ ও পদ্ধতি :
বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর জন্ম নিঃসন্দেহে উম্মাতের জন্য মহা আনন্দের বিষয়। তবে এ আনন্দ প্রকাশ যদি রাসূলুল্লাহ (সা:) ও তাঁর সাহাবীগণের সুন্নাত অনুসারে হয় তাহলে তাতে সাওয়াব হবে। যেমনিভাবে, আমরা যে কোনো “যায়েজ” পদ্ধতিতে “হালাল” খাবার খেতে পারি। তাতে আমরা খাবারের মজা, আনন্দ ও পুষ্টি লাভ করব। তবে সুন্নাত পদ্ধতিতে সুন্নাত খাবার খেলে মজা, আনন্দ ও পুষ্টি ছাড়াও আমরা অতিরিক্ত ‘সাওয়াব’ লাভ করব। আমারা যে কোনো “জায়েয” পোশাক যে কোনো “জায়েয” পদ্ধতিতে পরিধান করতে পারি। এতে আমাদের সতর ঢাকা ও সৌন্দর্য অর্জন হবে। কিন্তু, সুন্নাত পদ্ধতিতে সুন্নাত পোশাক পরিধান করলে আমরা সতর ঢাকা ও সৌন্দর্যের সাথে সাথে সাওয়াব ও বরকত অর্জন করব। অনুরূপভাবে রাসূল (সা.)-এর মীলাদ বা জন্মে আমাদের আনন্দ পায়। আর তা, রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবিগণের সুন্নাত অনুসারে করতে পারলে আমরা এতে অফুরন্ত সাওয়াব ও বরকত লাভ করতে পারব।
মিলাদ পালনের সুন্নাত পদ্ধতি :
এক.
প্রতি সোমবার সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহর দবরারে শুকরিয়া জানানো। রাসূল (সা.) নিজে আমাদের এ পদ্ধতি শিখিয়েছেন। এ ছাড়া আমরা দেখেছি যে, মূসা (আ) ও পরবর্তীকালে রাসূল (সা.) আশূরার দিন সিয়াম পালন করেছেন। এ থেকে আমরা বুঝি যে। বড় নেয়ামত ও বিজয়ে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রে নবীগণের সুন্নাত হলো সিয়াম পালন।
দুই.

রাসূল (সা.)-এর মিলাদ বা জন্মে আনন্দ প্রকাশের দ্বিতীয় সুন্নাত পদ্ধতি হলো সর্বদা তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা। তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন আমরা জীবন বিলিয়ে দিলেও তাঁর সামান্যতম প্রতিদান দিতে পারব না। কারণ আমরা হয়ত আমাদের পার্থিব সংক্ষিপ্ত জীবনটা বিলিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি তো আমাদের পার্থিব ও পারলৌকিক অনন্ত জীবনের সফলতার পথ দেখাতে তাঁর মহান জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।

তাই রাসূল (সা.)-এর প্রতি আমাদের নূন্যতম দায়িত্ব যে আমরা সর্বদা তাঁর জন্য সালাত ও সালাম পাঠ করব। আল্লাহর যিকর ও সালাত সালামের জন্য ওযু করা শর্ত নয়। তবে তা উত্তম হলো- বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতে, ওযুসহ বা ওয-ছাড়া সর্বাবস্থায় দূরদ-সালাম পাঠ করতে হবে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে। একবার দূরদ পাঠ করলে বান্দা নিম্নের সাত প্রকার পুরস্কার লাভ করে। যথা : (১) মহান আল্লাহ দরুদ পাঠকারীর দশটি গোনাহ ক্ষমা করেন, (২) দশটি সাওয়াব দান করেন, (৩) দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, (৪) দশটি রহমত দান করেন, (৫) ফিরিশতাগণ তার জন্য দু‘আ করতে থাকেন, (৬) ফিরিশতাগণ পাঠকারীর নাম ও তার পিতার নামসহ তার সালাত রাসূল (সা.) এর পবিত্র রাওজায় পৌঁছে দেন, (৭) তিনি নিজে এবার সালাত পাঠকারীর জন্য ১০ বার দুআ করেন। বেশি বেশি সালাত পাঠকারীর জন্য রয়েছে অতিরিক্ত দুটি পুরস্কার। প্রথমত আল্লাহ তার সমস্যা ও দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দিবেন। এবং দ্বিতীয়ত: রাসূল (সা.)-এর শাফায়াত তাঁর পাওনা হবে।
বিশেষ কর্মসূচী :

মিলাদে মুস্তাফায় আনন্দ প্রকাশের ক্ষেত্রে সাহাবীগণের অন্যতম সুন্নাত হলো, সর্বদা তাঁর সিরাত-শামাইল আলোচনা করা। সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ, তাবি-তাবিয়ীগণ বা আমাদের ইমামগণ কেউ কখনো ১২ই রবিউল আউয়াল বা অন্য কোনো দিনে মীলাদ উপলক্ষে আনন্দ, উৎসব বা সমাবেশ করেন নি। তাঁরা সদা-সর্বদা সুযোগ মত রাসূল (সা.)-এর জীবনী, জন্ম, সীরাত, সুন্নাত, আখলাক, নির্দেশ এগুলি আলোচনা করতেন। আমাদেরও উচিত সর্বদা সুযোগ মত এরূপ আলোচনার মাজলিসের আয়োজন করা।

এছাড়াও, নবী (সা.)-এর আগমনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম দিক হলো তাঁর মহান শিক্ষা ও পবিত্রতম চরিত্রের কথা বিশ্ববাসীকে জানানো। ইসলামের সত্য ও সরলতা যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ করে। এবং সাধারণভাবে মানুষ সহজেই ইসলাম গ্রহণ করে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, রাসুলের (সা)-এর প্রতি ঈমান এনে, তাঁর শরীয়ত মোতাবেক জীবন গঠন করে, তাঁর সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসরণ করে, সদা-সর্বদা তাঁর উপর দরুদ সালাম পাঠ করে। সাধ্যমত বেশি বেশি তাঁর জীবনী ও হাদীস পাঠ করে ও শ্রবণ করে নিজেদের জন্য নতুন জীবনের নতুন জন্ম লাভ করা। এইটাই তো সর্বোচ্চ সফলতা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (সা.) আনুগত্য এবং পূণ অনুসরণ করার তাওফীক প্রদান করুন। আমীন।

বিলাল হোসেন মাহিনী, প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাস ও পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। ০১৮৪৩-৯০৪৭৯০

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।