মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ হারুন
Education is the back bone of Nation. শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আবার বলা হয়, ‘যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত’। তাই সমস্ত প্রশংসা সেই মহান সত্তা পরম করুণাময় আল্লাহর জন্য, যিনি স্বীয় রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি অহির সূচনা করেছেন পাঠ-পঠন তথা শিক্ষাদানের মাধ্যমে। এরশাদ হয়েছে, ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে। তুমি পড় তোমার মালিক বড়ই মেহেরবান। তিনি মানুষকে কলম দ্বারাই শিখিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানতো না।’ (সূরা আলাক : ১-৫)। এমনকি আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের সম্মুখে মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন আদি পিতা হযরত আদম (আ.)কে শিক্ষাদানের মাধ্যমে। (সূরা বাকারা : ৩২)। এছাড়া মানবসভ্যতার একমাত্র শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘আমি মানবজাতির শিক্ষক রূপে প্রেরিত হয়েছি।’ সুতরাং শিক্ষা শব্দটি নতুন কোনো বিষয় নয়, বরং মানবজাতির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই শিক্ষার সূচনা হয় এবং শিক্ষার মূল উৎস স্বয়ং আল্লাহ ও রাসূল (সা.) থেকেই হয়। আর এ বিশ্ব নামক University-এর Chancellor স্বয়ং আল্লাহ এবং Vice Chancellor স্বয়ং বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। সুতরাং শিক্ষা হচ্ছে মানবতার এক মহান অতুলনীয় আদর্শের নাম। আর শিক্ষকতা হচ্ছে মানবতার এক মহান অতুলনীয় পেশার নাম। তাই কুরআন-সুন্নাহ, ধর্ম তথা বিশ্বনবী (সা.)-এর তরিকা ও আদর্শ বাদ দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন চিন্তা করা বাতুলতা বৈ আর কিছুই নয়। নিম্নে ‘বিশ্বনবীর শিক্ষা বনাম ধর্মহীন কর্মশিক্ষা’ নামে তথ্যভিত্তিক একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হলো। আশা করি, সুচিন্তিত মহলে সময়োপযোগী ও সমাদৃত হবে, ইনশাআল্লাহ।
শিক্ষা কী? শিক্ষা একটি ব্যাপক বিষয়। শিক্ষা মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও উন্নতির সোপান। শিক্ষার মাধ্যমেই মানবজাতির উন্নতির বিকাশ ঘটে। শিক্ষা দক্ষ জনশক্তি তৈরির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সাধারণ অর্থে শিক্ষা বলতে জানা, অবগত হওয়া ও অনুভূতি জাগ্রত হওয়াকে বোঝায়।
ইংরেজিতে শিক্ষা শব্দটির প্রতি শব্দ হলো, ‘Education’। শাব্দিক বিশ্লেষণে এর অর্থ দাঁড়ায়, Pack the information and draw talents out (অবগতি ও জ্ঞান প্রদান এবং জানা বিষয়ের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন।)
আরবিতে শিক্ষা শব্দটির প্রতি শব্দ হলো (কিরা’তুন) অর্থ- পাঠ, পঠন, পড়া। আর ইলমুন) যার অর্থ জ্ঞান, জানা, বোঝা, জ্ঞাত হওয়া, উপলব্ধি করা, অনুধাবন করা, জানার আগ্রহ ও অভিলাষী হওয়া ইত্যাদি। পরিভাষায় শিক্ষা হলো অহির বিশেষ জ্ঞান, যার মাধ্যমে মানুষের দৈহিক, নৈতিক, জৈবিক এবং সামাজিক বিকাশ ও সার্বিক কল্যাণ বিদ্যমান থাকে। পবিত্র কুরআনের পরিভাষায় বলা যায় ‘রবের নামে পড়ালেখা করে মানুষের অজানাকে জানার নাম শিক্ষা’। তাই তো মহানবী (সা.) অহিলব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামদের নৈতিক ও আত্মিক চরিত্রের এমন উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার মাধ্যমে একটি বর্বর ঘুণে ধরা জাহেলী সমাজকে সোনার সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকদের মতে শিক্ষা : ১. এরিস্টটলের মতে, Education is the creation of a sound maind in a sound body (সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করার নামই শিক্ষা)।
২. ফ্রেডরিক হার্বাটের মতে, Education is the development of moral character (শিক্ষা হলো নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন সাধনের নাম)।
৩. Professor Herman H. Horne-এর মতে, শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক মানসিক দিক দিয়ে বিকশিত করে মুক্ত সচেতন মানব সত্তাকে আল্লাহর সাথে উন্নতভাবে সমন্বিত করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া।
৪. স্বামী বিকেনন্দের মতে, মানুষ পৃথিবীতে যে পূর্ণতা নিয়ে আগমন করে, তার যথাযথ বিকাশ সাধনই প্রকৃত শিক্ষা।
৫. শিক্ষাবিদ প্লেটোর মতে শিক্ষা কোনো নতুন নীতির জন্ম দেয় না, বরং পৃথিবীতে বিদ্যমান নীতিমালাকে পথ প্রদর্শন করে।
৬. দার্শনিক আল্লামা ইকবালের মতে, Education is the developing innate powers of man (মানুষের আত্ম শক্তির উন্নয়ন ও জাগরণই হচ্ছে শিক্ষা)।
৭. মাওলানা মওদূদীর মতে, মানুষের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা ও যোগ্যতা অপরিপক্ব ও অপরিণত রয়েছে তার সর্বোত্তম বিকাশ ও সমাজের কল্যাণ সাধনে সহায়ক শক্তিতে পরিণত করার নামই শিক্ষা।
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! আপনারা লক্ষ করেছেন যে, ৭ জন শিক্ষাবিদ ও দার্শনিকের ৫ জনই অমুসলিম। কিন্তু সকলের সংঘাতেই Morality তথা নৈতিকতাবোধ শব্দটি প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিদ্যমান। আরও মজার ব্যাপার হলো- জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক Professor Stanly Hull এর ভাষায়- ‘তুমি তোমার সন্তানকে যদি পড়ালেখা শেখাও আর হিসাব-নিকাশ শেখাও কিন্তু ধর্মকে বাদ দাও, তবে তুমি বর্বরতাই পাবে’।
উইলিয়াম হান্টারের ভাষায় ‘ধর্মহীন কর্মশিক্ষা মানুষকে পাশবিকতার জন্ম দেয়’।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে যে সত্য প্রতীয়মান হলো, তা হচ্ছে- ‘মানুষের পাশবিক সত্তার অবদমন করে মানব সত্তাকে আল্লাহর সাথে সমন্বিত করার প্রক্রিয়ায় সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ও কল্যাণ সাধনে জীব ও জগতের সকল অজানাকে জানার নাম হলো শিক্ষা’।
শিক্ষার উদ্দেশ্য বিখ্যাত জ্ঞানী-গুণিজনদের দৃষ্টিতে : শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও দার্শনিকগণ তাঁদের যে জ্ঞানগর্ভ মতামত ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে কয়েকজনের অভিব্যক্তি তুলে ধরা হলো- (ক) দার্শনিক সক্রেটিসের ভাষায়, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যের বিকাশ ও মিথ্যার অপনোদন। (খ) প্লেটোর মতে, মনের ও দেহের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনই হলো শিক্ষার উদ্দেশ্য। (গ) উইলিয়াম হার্বাটের মতে, শিশুর সম্ভাবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ সাধন এবং তার নৈতিক চরিত্রের কাক্সিক্ষত আত্মপ্রকাশ হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য। (ঘ) ফ্রেডারিক ফ্রোয়েবলের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সুন্দর, বিশ্বাসযোগ্য ও পবিত্র জীবনের উপলব্ধি।
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে: আল্লাহ্ মানুষের স্রষ্টা ও রব (পালনকর্তা), সুতরাং কার কী প্রয়োজন, কোনটা মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে আবার কোনটা অকল্যাণকর, তা তিনিই ভালো জানেন। কারণ মানুষ যত বড়ই শিক্ষিত ও পারদর্শী হোক না কেন, মানুষের জ্ঞান অতি নগণ্য। পবিত্র কুরআনের বাণী, তোমাদের জ্ঞান সমুদ্রের এক ক্ষুদ্রতম অংশ ব্যতীত অন্য কিছুই দেয়া হয়নি। তাই মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেমন তিনি বলেছেন, আমি জিন ও মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদতের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছি। (সূরা যারিয়াত)। তেমনি বিশ্বনবী (সা.)-কে মানুষের আদর্শ শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করে শিক্ষা দিয়ে অহির সূচনা করে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন আয়াতে ব্যাপক আলোকপাত করেছেন। নিম্নে কয়েকটি মৌলিক উদ্দেশ্য তুলে ধরা হলো-
(১) শিক্ষার মহান ও প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে- ‘মহান আল্লাহর পরিচয় লাভ ও আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন।’ যা অহির সূচনা আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। এরশাদ হচ্ছে, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট বাঁধা রক্ত থেকে। পড় আর তোমার প্রভু মহামহিম, যিনি মানুষকে কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানতো না।’ (সূরা আলাক : ১-৫)।
আর এজন্যই সকল নবী-রাসূলগণ (আ.) তাঁদের উম্মতদের স্রষ্টার পরিচয় সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘হে আমার জাতি তোমরা এক আল্লাহর উপাসনা কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের আর কোনো ইলাহ নেই।’
(২) দৈহিক ও আত্মিক পবিত্রতাসহ জাতীয় চরিত্র গঠন: এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনিই মহান সত্তা, যিনি উম্মীদের মধ্যে তাদের একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেনÑ যেন তিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন।’ (সূরা জুমু’আ : ২)।
(৩) সাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণিবৈষম্য পরিহার: মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আরবদের কোনো মর্যাদা নেই অনারবদের ওপর, অনারবদেরও কোনো মর্যাদা নেই আরবদের ওপর এবং শ্বেতাঙ্গের কোনো মর্যাদা নেই কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর (আল্লাহভীতি ব্যতীত)। মূলত আল্লাহর কাছে মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি।’
(৪) মানুষের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন: জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সুপ্ত গবেষণা ও চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটে, যা নিখিল সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘নিশ্চয়ই আসমান-জমিনের সৃষ্টিতে, রাত-দিনের বিবর্তনে এবং সমুদ্রে বিচরণশীল নৌযানসমূহে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (বাকারা : ১৬৪)।
(৫) সংকীর্ণতা দূর করা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা: পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘আর যাদেরকে মনের সংকীর্ণতা থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম হয়েছে।’ (সূরা হাশর : ৯)। এছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবীর (সা.) নবুয়্যতপূর্ব জীবনে কাবাঘরে হাজরে আসওয়াদ প্রতিস্থাপনের ভূমিকা, ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে গুণিজনদের নিয়ে যুব সংঘ গঠন এবং নবুয়্যত-পরবর্তী জীবনে মদীনার সনদ, হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(৬) মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন ও নৈতিকতার মানোন্নয়ন: পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘ইহা আল্লাহর প্রকৃতিজাত আদর্শ, যার ওপর মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা রূম : ৩০)। আর মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘মানুষের মাঝে সেই উত্তম, যে মানুষের উপকার করে।’ আল্লাহ প্রদত্ত মানবিক গুণাবলিকে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে জাগ্রত করে এবং মানুষের মধ্যকার Animality তথা পশুত্ববৃত্তি অবদমিত করত, Humanity I Morality তথা মানবতা ও নৈতিকতাবোধকে জাগ্রত করে তোলে। ফলে মানুষ পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা ও শ্রেণিভেদ ভুলে গিয়ে ভ্রাতৃত্বের অমীয় সুধায় সিক্ত হয়ে একটি ইনসাফপূর্ণ সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে সক্ষম হয়। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে শিক্ষার আরও বহুবিধ উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু বিখ্যাত জ্ঞানী-গুণিজনদের মতামত ও অভিব্যক্তির প্রতি সামঞ্জস্যতা রেখে জাগতিক সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক উদ্দেশ্যসমূহ তুলে ধরা হলো। সর্বোপরি মানবতার সেবা, দেশ পরিচালনার যোগ্যতাসহ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে নৈতিকতার চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হওয়া উচিত শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
৫. শিক্ষার মূল ভিত্তি : আমরা ইতোপূর্বে ‘শিক্ষা কী? ও শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহ ও এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন বিখ্যাত জ্ঞানী-গুণিজন ও দার্শনিকদের মতামত সম্পর্কে যে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি, তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে শিক্ষার মূল ভিত্তি হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ। মহান আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা। তিনি জানেন, কার কী প্রয়োজন? কীসের মধ্যে শান্তি-অশান্তি, আর কল্যাণ-অকল্যাণ। তাই ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগ এবং সবকিছুরই নির্দেশনা মহান আল্লাহই দিয়েছন।’ এরশাদ হয়েছে, হে নবী (সা.)! ‘আপনার নিকট কিতাব নাজিল করেছি, যাতে ইহ ও পরজগতের যাবতীয় বিষয় সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা দিয়েছি। মানবজীবনের এমন কোনো দিক ও বিভাগ নেই, ব্যাপারে ইসলামের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধিবিধান নেই। তাই তো বলা হয়, Islam is a complete code of life (ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান।) মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দুটিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না।’ আর সে দুটি হলো- (১) আল্লাহর কিতাব ও (২) রাসূলের সুন্নত। অতএব শিক্ষা তথা জ্ঞানের মূল ভিত্তি হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ তথা ধর্ম। সুতরাং ধর্মকে বাদ দিয়ে শিক্ষার উন্নয়নের চিন্তা ও চেষ্টা সাধনা করা বাতুলতা বৈ আর কিছুই নয়।
৬. শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলিত ও কাক্সিক্ষত রূপ : আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এদেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম। তাই এ জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ হওয়া উচিত ছিল পবিত্র কুরআনে বর্ণিত। ‘তোমরা আল্লাহর রঙে রঙিন হও। আল্লাহর রঙের চেয়ে উত্তম রং আর কার হতে পারে?’ (বাকারা : ১৩৮)। এ আয়াত এবং সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত, যেখানে অহির সূচনা করা হয়েছে শিক্ষার মাধ্যমে। সুতরাং অহির শিক্ষা ও সংস্কৃতিই হওয়া উচিত ছিল এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলিত একমাত্র রূপ। আঠারো শতকের ইংরেজ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত মূলত এদেশের মুসলমানরা অহিভিত্তিক একক শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে শিক্ষা লাভ করে আসছিল। ফলে এ শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে এমন সব যোগ্য লোক তৈরি হয়েছিল, তাদের দ্বারা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা ও ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল, ইতিহাসে যা সোনালি যুগ হিসেবে খ্যাত। তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা সে সমাজে উপহার দিয়েছিল মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, বিচারক, অর্থনীতিবিদ, সেনাপতি ও রাষ্ট্রদূত প্রভৃতি সৎ, যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি। ইংরেজরা এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে নাকচ করে- (১) স্কুল-কলেজ তথা সাধারণ শিক্ষা ও (২) মাদরাসা শিক্ষা- এ দ্বিবিধ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে আমাদের দেশে ইংরেজদের এ নীতির ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ফলে মাদরাসা শিক্ষায় ইসলামী শিক্ষার নামে ইসলামের মৌলিক কিছু আনুষ্ঠানিকতা তথা নামায, রোজা, হজ, যাকাত, বিবাহ, তালাক ইত্যাদি বিষয়ে ব্যক্তিগত দিকগুলো তাদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ইসলামের বিশ্বজনীন সামষ্টিক রূপ তথা সমাজ, জাতি ও দেশ পরিচালনা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে।
অপরদিকে স্কুল-কলেজ ও জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুই বৈষয়িক ও পার্থিবতায় সীমাবদ্ধ। এ শিক্ষা ব্যবস্থা জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাদানের মাধ্যমে সমাজ ও জাতি পরিচালনার যোগ্য করে তুলছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির মাধ্যমে মানুষ মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত পৌঁছেছে বটে, কিন্তু আত্মরক্ষার নামে বিশ্বকে ১০ বার ধ্বংস করার মতো এটম বোমাও আবিষ্কার করেছে, আরও করেছে নগ্ন ও ফ্রি সেক্সের নামে নারীর অধিকার হরণ। সুতরাং ধর্মহীন জাগতিক কর্মশিক্ষা নয়, বরং ধর্মীয় ও জাগতিক উভয়ের সমন্বয়ে শিক্ষাই হলো প্রকৃত, পূর্ণাঙ্গ ও কাক্সিক্ষত শিক্ষা। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আমাদের এ শিক্ষাই দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দাও এবং আখিরাতেও কল্যাণ দাও।’ (বাকরা : ২০১)।
৭. ধর্মহীন জাগতিক কর্মশিক্ষার কুফল: বিশ্বব্যাপী আজ ধর্মহীন জাগতিক কর্মশিক্ষা মানুষকে পাশবিকতার চরম সীমায় উপনীত করত ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সুদ-ঘুষ, মাদকাসক্তি, অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ বহুধা অপরাধ, অধিকাংশ মানুষের নৈমিত্তিক রুটিনে পরিণত হয়েছে। ফলে ব্যক্তি জীবনে চরম অশান্তি, সামাজিক জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা, আর রাজনৈতিক জীবনে পারস্পরিক প্রতিহিংসার দাবানলই এ শিক্ষার নির্মম উপহার।
প্রযুক্তির বিষয় বাদ দিলে বর্তমান বিশ্ব ও রিসালাত পূর্ব আরব সমাজ সমপর্যায়ে উপনীত হবে বৈকি? তিক্ত হলেও সত্য যে তৎকালীন আরব জাতি শিক্ষা, সাহিত্য, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষায় যথার্থ পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও বর্বরতার প্রান্ত সীমায় উপনীত হয়ে মেয়েদের জীবন্ত কবরদান ও উলঙ্গ হয়ে কাবা শরীফ তাওয়াফসহ নৈতিকতাবিবর্জিত হওয়ায় আমরা তাদেরকে সংস্কৃতিবান ও সভ্য জাতিরূপে স্বীকৃতিদান করি না।
আজকের প্রযুক্তির এ সর্বাধুনিক যুগে নৈতিকতাহীন এ শিক্ষা ব্যবস্থা নারী-শিশুদের প্রতি বর্বরতা, পারস্পরিক প্রতিহিংসা, নির্মমতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমাদের শিক্ষাঙ্গনকে ঠেলে দিয়েছে সফেদ জাহেলিয়াতের বর্বরোচিত পাশবিকতায় মেতে ওঠা বীভৎস সন্ত্রাসী তাণ্ডবলীলার দিকেই। তাই জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক Professor Stanley Hull যথার্থই বলেছেন, ‘তুমি তোমার সন্তানকে যদি পড়ালেখা শেখাও আর হিসাব-নিকাশ শেখাও, কিন্তু ধর্মকে বাদ দাও, তবে শুধু বর্বরতাই পাবে।’
আধুনিক শিক্ষাবিদ জেবি হালের উক্তি : If you give your children the three R’s Reading and Arithmetic and don’t give them the 4th R.i.e.Relegion They will become the 5th R.i.Rascal. (যদি তুমি শিশুকে লেখাপড়া এবং অংক শিক্ষা দাও, আর ধর্ম শিক্ষা না দাও (তাহলে সে ৫ম পর্যায়ে বদমাইশে পরিণত হবে)।
অতএব ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করে মানুষের মাঝে নৈতিকতা ও মানবিকতার উৎকর্ষ সাধনই হবে প্রকৃত ও কাক্সিক্ষত শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ। এ বাস্তব আবেদনকে যথার্থভাবে অনুধাবন করে সমাজ ও শিক্ষাবিদ ‘অধ্যাপক ব্লেচার’ ধর্মকে জ্ঞান বিজ্ঞানের আওতায় আনার সুপরামর্শ দিয়েছেন।’ যে শিক্ষা সমাজে আনবে স্বর্গীয় সুখের নিবিড় ছোঁয়া। সেখানে থাকবে না কোনো চিন্তা ও ভয়। এ বাস্তব সত্যই ফুটে উঠেছে আল্লাহর মহিমান্বিত বাণীতেÑ ‘যে আমার হিদায়েতের (জীবন-বিধানের) অনুসারী হবে, তার কোন ভয় ও চিন্তার কারণ নেই।’ (বাকারা : ৩৮)।
৮. আহ্বান: বর্তমান বিশ্বে ধর্মকে বাদ দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন ও অগ্রগতিসহ মানব জীবনের সার্বিক নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য হাজারো চিন্তা, গবেষণা, আলোচনা, পর্যালোচনা এবং মানবরচিত বিভিন্ন পদ্বতি প্রয়োগ করেও সফলতার মুখ দেখা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, গবেষক ও দার্শনিকদের মতে, ধর্মকে বাদ দিয়ে সফলতা আর কখনো সম্ভবও নয়। অথচ বিশ্বনবী সা. প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে অহিলব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে তাঁর অনুসারী সাহাবাদের সোনার মানুষে পরিণত করে সফেদ একটি জাহেলি সমাজকে সুন্দর ও আদর্শ সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজও আমরা যদি বিশ্বনবীর সে পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষার সকল স্তরে অহিলব্ধ ধর্মীয় শিক্ষা চালু করতে পারি, তবে আমাদের শিক্ষার্থীদেরও পরশ পাথররূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হব, বিপর্যস্ত এ সমাজকে সুন্দর ও আদর্শ সমাজে পরিণত করতে সক্ষম হবো, ইনশাআল্লাহ। এসত্য উপলব্ধি করেই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ উইলিয়াম হান্টার, এরিস্টটল, জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক Stanley Hull, আধুনিক শিক্ষাবিদ জেবি হালসহ বিভিন্ন ধর্মহীন কর্মশিক্ষার কুফল বর্ণনা করত শিক্ষা থেকে ধর্মকে বাদ না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সকল গুণী-জ্ঞানী কর্ণধারদের শিক্ষার সকল স্তরে অহিলব্ধ ধর্মীয় শিক্ষা চালু করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলছি, ‘ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করত মানুষের মাঝে নৈতিকতা ও মানবিকতার উৎকর্ষ সাধনই হোক আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত স্বরূপ।’ আমার লেখা কবিতার ছন্দে ছন্দে বলতে চাই, ‘সত্য কথা কারো কাছে বলতে যে হয় শরম;/ মাথাটা হয় গরম।/ছাড়তে যে মন চায়না;/আঁধার কাটার আয়না।/পড়তে বসে ঘুমিয়ে পড়ি,/তার পরও যে পড়ার নেশা,/পড়ার মাঝেই আলোর দিশা,/তাই তো আল্লাহ্ ‘ইকরা’ বলে হুকুম করলেন রাসূল কে;/‘রবের নামে পড় তুমি,/ওহি করলেন রেসালাতের শুরুতে।/নবীর হাদীস রপ্ত করে পড়তে থাক আজীবন;/‘দোলনা থেকে গোর এর আগে?’ তলব কর রবের জ্ঞান সারাক্ষণ।
লেখক : জননেতা।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …