॥ এস. এম রুহুল আমীন ॥
বিশ্বসমাজ যখনই বহুবিধ অনাচার আর অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, শোষণ, নিপীড়নে মানবজীবন অত্যন্ত জটিল ও কঠিন হয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমাজের সর্বত্র নানাবিধ চরম অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছে। মানবগোষ্ঠী একটু শান্তির অন্বেষায় এ সমাজকে বার বার ভেঙে নতুন অবয়বে গড়েছে এবং এ প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত অব্যাহত রাখছে। সমাজের দুষ্টক্ষত হিসেবে সমধিক পরিচিত গর্ব-অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, কাটাকাটি, ঝগড়া-ফাসাদ, জুলুম-নির্যাতন, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস শান্তিপিয়াসী মানব মনের লালিত স্বপ্ন পূরণে তীব্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে; তখনই হেরার আলো নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে যুগে যুগে নবী ও রাসূল। মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারীমে এসেছে, “তিনিই সে সত্তা (আল্লাহ), যিনি উম্মী বা নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্যে, যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (প্রজ্ঞা) শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতোপূর্বে ছিল সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে।” -সূরা আল জুমু’আ : ২।
কালের পরিক্রমায় ও যুগের ধারাবাহিকতায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন সর্বকালের সকল মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “বলুন (হে রাসূল!), হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল।” -সূরা আল আরাফ : ১৫৮।
আমাদের প্রিয়নবী কোনো কাল, সময়, গোত্র বা জাতিগোষ্ঠীর জন্য আসেননি, তিনি এসেছিলেন সর্বকালের, যুগের ও সমগ্র বিশ্বের জন্য। কুরআনুল কারীম সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বার বার জানিয়েছে যে, মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বের সকল মানুষের জন্য, সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য প্রেরিত রাসূল। একজন মুসলিমকে তা বিশ্বাস করতে হবে যে বিশ্বের সকল দেশের, সকল জাতির সব মানুষের জন্য তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত রাসূল। তার আগমনের দ্বারা পূর্ববর্তী সকল রাসূলের শরিয়াহ রহিত হয়ে গেছে। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত সর্বশেষ নবী। তারপর ওহির দরজা বন্ধ। আর কোনো নবী আসবেন না এ পৃথিবীতে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব। মহান প্রভু তাঁর অপার করুণায় বিশ্বনেতা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এ পৃথিবীতে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ তথা নিখিল বিশ্বের করুণার ছবি হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মানবীয় চরিত্রে যত মহৎ গুণ ও বৈশিষ্ট্য হতে পারে, অনিন্দ্য সুন্দর যা কিছু মহৎ গুণের কথা মানুষ কল্পনা করতে পারে, বিশ্বনবীর (সা.) পূতঃপবিত্র জীবন চরিত্রে তার পূর্ণ সমাবেশ ঘটেছিল। মহান আল্লাহ তাই তাঁর প্রশংসায় ঘোষণা করেন, “আর নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের ওপর রয়েছেন।” – সূরা আল কালাম : ৪।
মহান আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি রাহমাতুল্লিল আলামিন বা বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবে।” -সূরা আল আম্বিয়া : ১০৭।
অনৈতিক ও অর্থনৈতিক সামগ্রিক নৈরাজ্য সমাজ জীবন অনিষ্টের মূল কারণ। শোষণ-বঞ্চনা যেন সমাজে বিধিসম্মত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শ্রমজীবীদের শ্রমের বিনিময়ে সমুদয় উৎপাদিত দ্রব্য পুঁজিপতির নিজস্ব সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমাজে পুঁজিপতিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে সর্বত্র এক অরাজক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা অর্থাৎ ধনী-গরিব মানুষের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান তৈরি করছে। সম্পদ উপার্জনে বৈধ-অবৈধের সীমারেখার ক্ষেত্রে অপূর্ণাঙ্গতা বা ইসলামের হালাল-হারামের দিকনির্দেশনা কার্যকর না থাকার ফলে সমাজে ব্যাপকভাবে চলছে সুদি কারবার, ঘুষ লেনদেন, দুর্নীতি, চৌর্যবৃত্তি, চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি, হাইজ্যাক, ছিনতাই, মুনাফাখোরী, প্রতারণা, দেহব্যবসা, ওজনে কম, মজুদদারী, ভেজাল মিশ্রণ, কালোবাজারি, চোরাচালানসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক দুরাচার। এসব বিষয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে বলেছেন, ‘‘তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ গ্রাস করো না এবং জনগণের সম্পদের কিছু অংশ জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না।’’ -সূরা আল বাকারা : ১৮৮।
এ বিষয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ! পরস্পরে অবৈধ উপায়ে একে অপরের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করো না। সব রকমের লেনদেন বা ব্যবসা-বাণিজ্য হতে হবে পারস্পরিক সন্তোষ ও মর্জি অনুসারে এবং তোমরা নিজেরা একে অন্যকে হত্যা করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহশীল। যে কেউ স্বীয় কর্মসীমা লঙ্ঘন করে জুলুম সহকারে এরূপ কাজ করবে, তাকেই আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর এ কাজ করা আল্লাহর জন্য একেবারেই সহজ।’’ -সূরা আন নিসা : ২৯-৩০।
যেখানেই অসংগতি ও অনিয়ম, সেখানেই আলোর মশাল জ্বেলেছেন প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে সত্যের উচ্চারণ করেছেন এভাবে। জুলমের নির্মম হাতিয়ার সুদ সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে এসেছে, ‘‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।’’ -সূরা আল বাকারা : ২৭৫।
একইভাবে অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা ইসলামে হারাম করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.)-এর হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, “যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত্রিকাল খাদ্যপণ্য মজুদ করে রাখলো, সে আল্লাহ তায়ালা থেকে সম্পর্কমুক্ত হয়ে গেলো আর আল্লাহ তায়ালাও তার থেকে সম্পর্কমুক্ত হয়ে গেলো।’’ মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ২০৩৯৬।
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে ঘুষের লেনদেনের মাধ্যমে মানুষকে অবৈধভাবে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হয়। এর ফলে ন্যায্য হকদার তার অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। তাই অবৈধ পন্থায় স্বার্থ হাসিলের জন্য এরূপ অনৈতিক লেনদেন ইসলামে হারাম করা হয়েছে। রাসূল (সা.)-এর হাদীস থেকে জানা যায়, ‘‘ঘুষদাতা এবং ঘুষগ্রহীতা উভয়ের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত।’’ -জামে আত তিরমিযী : ১৩৩৬ ; ইবনে মাজাহ : ২৩১৩।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় শিরক, বিদআত, অনাচার, অত্যাচার আর অবিচার ও শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের ভয়াবহতার চিত্র রীতিমতো উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগজনক। প্রচলিত আইন বা সমাজ ব্যবস্থায় অনেক অন্যায় ও অপরাধকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতেই ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ, দুর্নীতি, মাদকাসক্তি, ব্যভিচার, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, ইভটিজিং এসিড নিক্ষেপ, শ্লীলতাহানি, পরস্ব হরণ, সুদ ও ঘুষের লেনদেন, চোরাকারবারি, খাদ্যে ভেজাল, মজুদদারি ইত্যাকার অপরাধ কর্ম মানবসমাজকে জর্জরিত ও কলুষিত করে ফেলেছে। উপর্যুক্ত ঘৃণিত সব উপার্জনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা-পূর্বক মহানবী (সা.) ঐশী ইলমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান।
সন্ত্রাসমুক্ত সমাজই ইসলামী সমাজের প্রতিচ্ছবি। আমরা কতগুলো আয়াতের দিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই, যেখানে আল্লাহ তায়ালা জমিনে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে অর্থাৎ পরস্পর বিভেদ সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন। সন্ত্রাসী, কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের আচরণ তুলে ধরেছেন মহান আল্লাহ কুরআনুল কারীমের এ আয়াতসমূহে। স্বভাব ধর্ম ইসলাম যে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া নয়, তা যৌক্তিকভাবে উল্লেখও করেছেন। বিভেদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদে সীমালঙ্ঘন করতেও মহান আল্লাহ নিষেধ করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, “তাদের যখন বলা হয়, তোমরা এ শান্তিপূর্ণ জমিনে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরাই তো হচ্ছি বরং সংশোধন ও শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী।” -সূরা আল বাকারা : ১১।
এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে আরো এসেছে, “আল্লাহর জমিনে (একবার) তার শান্তি স্থাপনের পর তোমরা বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। তোমরা ভয় ও আশা নিয়ে একমাত্র তাঁকেই ডাকো। অবশ্যই আল্লাহর রহমত নেক লোকদের অতি কাছে রয়েছে।” -সূরা আল আরাফ : ৫৬।
এখন আমাদের কলুষিত সমাজের স্বাভাবিক ঘটনা হলেও ইসলামী সমাজে পরস্পরকে হত্যা, আত্মহত্যা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কেউ যদি অন্যায়ভাবে অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন পুরো দুনিয়ার মানুষকে হত্যা করলো। এমনই কঠিন সতর্কবার্তা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “কোনো মানুষকে হত্যা করা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার শাস্তি প্রদান ছাড়া বা অন্য কোনো কারণে কেউ যদি কাউকে হত্যা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করলো। আবার এমনিভাবে যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে, তবে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিল। -সূরা আল মায়িদা : ৩২।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “কোনো জীবনকে তোমরা হত্যা করো না, যা আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। তবে আইন ও বিধিসম্মতভাবে (হত্যার বিচারে) হত্যার কথা আলাদা। যে ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় আমি তার উত্তরাধিকারীকে (এ) অধিকার দিয়েছি যে, (সে রক্তের বিনিময় দাবি করতে পারে) তবে সে যেন হত্যার (প্রতিশোধ নেয়ার) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করে; কেননা (হত্যার মামলায়) মজলুম ব্যক্তিকেই সাহায্য করা হবে।” -সূরা বনী ইসরাইল : ৩৩।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “আল্লাহ তায়ালা যে জীবনকে তোমাদের জন্য সম্মানিত করেছেন তাকে যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে হত্যা করো না। এ হচ্ছে তোমাদের (জন্য আল্লাহ তায়ালার কতিপয় নির্দেশ), এর মাধ্যমে তিনি তোমাদের আদেশ দিয়েছেন। আশা করা যায় তোমরা অনুধাবন করতে পারবে।” -সূরা আল আন’য়াম : ১৫১।
হত্যাকারীর শাস্তি সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ঈমানদার ব্যক্তিকে হত্যা করবে তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম অনন্তকাল সে সেখানে থাকবে, আল্লাহ তায়ালা তার ওপর ভীষণ রুষ্টহন, তাকে তিনি লানত দেন, তিনি তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।” -সূরা আন নিসা ৪ : ৯৩।
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কাম-উদ্দীপক, যৌন-সুড়সুড়ি, আধুনিকতার নামে উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতার বিষবাষ্প মানবসমাজে ছড়িয়ে পড়ে অসহনীয় পরিস্থিতি সমাজ জীবন জর্জরিত ও ভারাক্রান্ত। বেহায়াপনা ও প্রেমের নামে পরকীয়া মারাত্মক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। অথচ এ সম্পর্কে আল কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে, “আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট ও অসৎ পন্থা।” -সূরা বনী ইসরাইল : ৩২।
ইভটিজিং এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। নারীরা রাস্তায় নামলেই বখাটেদের কটুকথা, ভেংচিকাটা, খারাপ দৃষ্টি, শীষ বাজানো শুরু হয়ে যায়। এসব বখাটেরা নিজেদের মা-বোনের কথাও ভুলে যায়। নৈতিক সত্তার মৃত্যু হলে এসব ঘটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। নারীদের ইভটিজিং থেকে বাঁচাতে হলে করণীয় কী? এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর নির্দেশনা হলো, “হে নবী! আপনার স্ত্রী, কন্যা ও ঈমানদার লোকদের মহিলাদের বলে দিন, তারা যেন নিজেদের ওপর নিজেদের চাদরের আঁচল ঝুলিয়ে দেয়। ইহা অধিক উত্তম নিয়ম ও রীতি। যেন তাদেরকে চিনতে পারা না যায় ও তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা না হয়। আল্লাহ্্্ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” -সূরা আল আহযাব : ৫৯।
বর্তমানে দেশের সমধিক আলোচিত বিষয় হলো ধর্ষণ। নারীরা নিজেদের ঘরেও আজ নিরাপদ নয়। তিন বছরের শিশুও ধর্ষকের লালসার শিকার হচ্ছে, লজ্জার বিষয় হলো এগুলো আবার স্বজনরাও ঘটাচ্ছে। শুধু ধর্ষণ নয়, পালাক্রমে গণধর্ষণের ঘটনাও বাড়ছে দিন দিন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে অত্যন্ত নির্দয় ও নির্মমভাবে। ধর্ষককে বাঁচাতে সমাজপতিরা একজোট হয়ে আছে। ধর্ষিতার ফরিয়াদ আকাশ-বাতাসকে ভারী করে তুলছে।
মহানবী (সা.)-এর আগমনই ঘটেছিল অনৈতিকতার মূলোচ্ছেদ ঘটিয়ে নৈকিতার বীজ বপন করে একটা নির্মল সমাজ বিনির্মাণের জন্য। মহানবী (সা.)-এর আগমনের উদ্দেশ্যও ছিল এটি। মহানবী (সা.) নিজেই বলেছেন, “আমি মানব চরিত্রের উৎকর্ষতা ও পরিপূর্ণতা দান করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।” -আখলাকুন নবী সা. পৃ.১৩।
আল্লাহর রাসূল ছিলেন ক্ষমাশীল। কেউ খারাপ ব্যবহার করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দিতেন। হযরত আনাস (রা.) বলেন, একদা জনৈক ইহুদি মহিলা আল্লাহর রাসূলকে বিষ মিশিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহর রাসূল তাকে কিছুই করেননি। তায়েফে আল্লাহর রাসূলকে রক্তে রঞ্জিত করা হয়। হযরত জিবরাইল (আ.) এসে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কাছে অনুমতি চান, দু’পাহাড়ের মাঝখানে রেখে তাদেরকে পিষিয়ে মারতে। কিন্তু তিনি আল্লাহর কাছে তাদের জন্য দরদভরা ভাষায় দোয়া করেন, ‘আল্লাহুম্মা ইহদি কাওমি ফাইন্নাহুম লা ইয়ালামুন।’ হে আল্লাহ! আমার কাওমকে ক্ষমা করে দিন এবং হিদায়াত দান করুন। তারা আমার প্রতি যা করেছে, তা তারা বুঝেনি। -আখলাকুন নবী সা. পৃ.৪৯।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বকালের একজন সর্বজনস্বীকৃত আদর্শ নেতা। তার অনুপম আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, কোমল ব্যবহার আর সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সকলকে আপন করে নিতেন অতি সহজে। রাখতেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে। ক্ষমাশীলতা ছিল তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও মানবীয় চরিত্রের ভূষণ। সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল আর সকলকে দিতেন চিন্তার অগ্রাধিকার, তার দেয়া মানবাধিকার ছিল সর্বজন স্বীকৃত। কাজ করতেন পরামর্শভিত্তিক পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়ে। যার সুউচ্চ প্রশংসা করে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “এটা একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ যে আপনি এদের (মুসলমানদের) প্রতি কোমল হৃদয়সম্পন্ন। যদি আপনি কঠোরভাষী ও তিক্তমেজাজি হতেন, তাহলে এরা আপনার চারপাশ হতে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত। কাজেই এদের ক্রটিকে ক্ষমার চোখে দেখুন, এদের জন্য শাফায়াত চান এবং সব বিষয়ে এদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর, পরামর্শের পর যখন কোনো বিষয় দৃঢ় সংকল্প হয়ে যান, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। অবশ্যই আল্লাহ তাঁর ওপর ভরসা কারীদের ভালোবাসেন।” – সূরা আলে ইমরান : ১৫৯।
রাজনীতিতে আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতাহীনতা সমাজ জীবনে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। ফলে দেশপ্রেমহীন নেতৃত্ব স্বার্থান্ধতায় মদমত্ত হয়ে পড়ছে। ক্ষমতার অপব্যবহার রাজনীতিকে দুর্বৃত্তের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলেছে। দলীয়করণ, প্রশাসনিক ক্ষমতার যথেচ্ছা ও অপব্যবহার, বহুদেশে ও বহুক্ষেত্রের মতো আমাদের প্রিয় সবুজ-শ্যামল মাতৃভূমিতেও ন্যয়ভ্রম কালো আইন ও বিচার বিভাগের পরাধীনতার কারণে সমাজের শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। রাজনীতিতে সন্ত্রাস, শঠতা, অন্তর্কোন্দল, হত্যা, মারামারি, টেন্ডারবাজি, দারিদ্র্য, দুভিক্ষ, বেকারত্ব, হতাশা, ভয়ভীতি ইত্যাকার অনাচার মানবসমাজে অবর্ণনীয় মারাত্মক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, যা ছিল আমাদের সভ্য সমাজে অকল্পনীয়।
সামাজিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবের দরুন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মানবিক ও নৈতিক চেতনাবোধের বিলুপ্তি ঘটছে প্রায়। ফলে সমাজ জীবনে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা, মুনাফেকি, মিথ্যাচার, চোগলখোরি, অশ্লীল গালি-গালাজ, আত্মীয়তার সম্পর্কচ্ছেদসহ বিভিন্ন রকম অপকর্ম মরণব্যাধি ক্যান্সারের মতো মানবসমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে অবলীলাক্রমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, সর্বত্রই বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক বন্ধন (ঝড়পরধষ ইড়হফরম) শান্তি ও স্থিতিশীলতা।
এই পর্যায়ে এসে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আমরা যদি সত্যিকারভাবে আদর্শ সমাজ গড়তে চাই আমাদের দেশকে দেখতে চাই সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে। একমাত্র আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-কে আদর্শের মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর আনুগত্যকে তাঁরই প্রিয় রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তোমাদের দায়িত্বশীলের আনুগত্য করো।” – সূরা আন নিসা : ৫৯।
এ প্রসঙ্গে তিনি অন্যত্র আরো বলেছেন, “যে রাসূলের আনুগত্য করলো, সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো; আর যে মুখ ফিরিয়ে নিলো তাদের ওপর পাহারাদার হিসেবে আমরা আপনাকে পাঠাইনি।” – সূরা আন নিসা: ৮০
মহান আল্লাহ তায়ালা হিদায়াতের পথনির্দেশ করে বলেন, তোমরা যে সরল সঠিক ও হিদায়াতের প্রার্থনা করছো তার একমাত্র পথ হলো রাসূলের (সা.) অনুসরণ করা। কুরআনুল কারীমে এসেছে, “যদি তোমরা রাসূলের আনুগত্য করো, তাহলে হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর আমার রাসূলের দায়িত্ব তো শুধুমাত্র দীনের দাওয়াত সুস্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া।” -সূরা আন নূর ২৪ : ৫৪। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হবে কুরআন-সুন্নাহ দিয়ে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “রাসূল (সা.) তোমাদের যা দান করেন, তা তোমরা গ্রহণ করো। আর যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাকো। আল্লাহ্্কে ভয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ্্্ কঠিন শাস্তিদাতা।” -সূরা আল হাশর : ৭
অন্যত্র আবার বলেছেন, এর বিপরীত অর্থাৎ রাসূলের আদর্শের বিপরীত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আদর্শকে কেউ ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে গ্রহণ করলে তাদের জন্য রয়েছে বিপদ ও মুসিবত। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
আল্লাহ্র দিদার লাভে আগ্রহী ও তাঁই স্মরণে ব্যস্তক মানুষ ও সমাজ পরিচালনার জন্য রাসূলই (সা.) সর্বোত্তম আদর্শ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্র রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য আছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাৎ পেতে আগ্রহী এবং যে পরকালের আশা করে; আর যে বেশি পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করে।” -সূরা আল আহযাব : ২১।
কোনোভাবেই ইসলামী সমাজ পরিচালনায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য পরিত্যাগ করা যাবে না ও উপেক্ষিত হবে না মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রমে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনেরর ঘোষণা হলো, “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং আদেশ শোনার পর তা অমান্য করো না।” – সূরা আল আনফাল : ২০।
এ কথা সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, সব ধরনের অপরাধ ও অবক্ষয় আমাদের সমাজ জীবন থেকে অপসারিত করা অতীব জরুরি মনে করছে আজ সত্যানুন্ধানী জাগ্রত বিবেকেরা। এসব অপরাধের কারণেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক জাতিগোষ্ঠী, সমাজ ও সভ্যতা। পাহাড় ও ভূমিধ্বস, জলোচ্ছ্বাস, প্রস্তর বর্ষণ, বজ্রনিনাদ, ঘৃর্ণিঝড়, খড়া, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, দুরারোগ্য ব্যাধি এইডস, করোনা, ডেঙ্গু, অগ্নি, নৌ ও রোডসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে অপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং পরকালীন জীবনেও কঠোর শাস্তি প্রদান করবেন।
এ কথা দ্বিধাহীনচিত্তে বলতেই হবে, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন আদর্শের মূর্তপ্রতীক। তাঁর জীবনে রয়েছে বিশ্বমানবতার জন্য সর্বোত্তম জীবনাদর্শ। তাঁর গোটা জীবনই ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। দুনিয়ার বুকে আল্লাহর প্রেরিত সকল নবী ও মহামানবদের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর জীবনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ঘটনা ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে রয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বনবী হিসেবে সকলের স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার ও বন্ধু হিসেবে বিশ্বস্ত। উপরন্তু তিনি ছিলেন সফল আদর্শ ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংস্কারক, বীর যোদ্ধা, নিপুণ সেনানায়ক, নিরপেক্ষ বিচারক, মহান রাজনীতিক এবং অপরাপর মহৎ গুণের অধিকারী। সর্বক্ষেত্রে তিনি সততা, ব্যক্তিত্ব ও অপূর্ব সাফল্য সহকারে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। সর্বক্ষেত্রেই তিনি যথোপযুক্ত সংস্কার সাধন করে গিয়েছেন। মানব চরিত্রের সকল প্রকার মহৎ গুণের অনন্য সমন্বয় সাধনও করেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল ও মহামানব এসেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই কোনো এক বিশেষ ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করেছিলেন কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য সাধারণ কীর্তিমান মহামানব, যিনি সকল ক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
রাসূল (সা.)-এর এসব আদর্শ বিশ^জনীন, চিরন্তন ও কালজয়ী। এর আবেদন আন্তর্জাতিক ও অসাম্প্রদায়িক। দেশ, কাল, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণি ও অঞ্চল নির্বিশেষে সকলের জন্যই তা প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়। এ কালজয়ী ও বিশ^জনীন আদর্শ অসত্যের ধূম্রজাল ভেদ করে একদিন স্ব-মহিমায় প্রকাশিত হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কেননা রাসূল (সা.)-এর জীবন ছিল আল কুরআনের বাস্তব নমুনা। আল কুরআনে বিশ্বের সকল মানুষকে যে আদর্শের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে, তার নিঁখুত চিত্রায়ন ঘটেছে রাসূল (সা.)-এর জীবন চরিত্রে। তিনি ছিলেন আল কুরআনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। মহান আল্লাহ বিশ্বের সকল মানুষকে আহ্বান করেছেন সেই অনুপম মাধুর্যের আলোকে উদ্ভাসিত হতে।
মানব ইতিহাসের একটি সোনালি অধ্যায় তথা সমাজ গোটা বিশ্ববাসীর কাছে অতিউজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করছে প্রতিনিয়ত ও প্রতিক্ষণ। তা হচ্ছে ইসলামের সর্বজনীন কালজয়ী, আলোকদীপ্ত ও শাশ্বত জীবনাদর্শ। সমাজ সংস্কৃতির সমস্যাপীড়িত মানবসমাজ বিমুগ্ধ বিস্ময়ে শান্তির লালিত আকর ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আবার আশ্রয় খুঁজছে ব্যাকুল হয়ে। বিশ্ব ইতিহাসের সর্বোচ্চ মানবকল্যাণ সাধনকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) সমাজ-সভ্যতার পুনর্গঠনে যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিশ্বনবীর প্রতিষ্ঠিত ও প্রদর্শিত সে সমাজ ব্যবস্থার আদলে আজও যদি তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করা যায়, তাহলে আবারও হতে পারে সেই সোনালি সমাজ, তাই আজকের বাংলাদেশেও মহানবী (সা.)-এর আদর্শ খুবই প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক।
লেখক : গবেষক ও শিশু সাহিত্যিক।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …