আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরাঃ সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে গত ২০ বছরে সহ¯্রাধিক মানুষ মারা গেছেন। নিহতদের বেশির ভাগ বাওয়ালি, জেলে, মৌয়ালি ও জ্বালানি কাঠ আহরণকারী। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের প্রতিবেশ চক্রের পরিবর্তন, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হরিণ পাচার ও শিকার এবং খাদ্য সঙ্কটসহ নানা কারণে বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। সর্বশেষ গতকাল সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে বাগেরহাটের শরণখোলার সিফাত (২২) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে । চারদিন নিখোঁজ থাকার পর গ্রামবাসী রোববার সকালে সুন্দরবনের গহীনে তল্লাশি চালিয়ে ওই যুবকের মাথা ও পরিধেয় গেঞ্জি উদ্ধার করেছে। নিহত সিফাত উপজেলার পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের ফারুক হাওলাদারের ছেলে। লিডার্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও পার্শ্ববর্তী কয়রা উপজেলাইে ১ হাজার ১০০ জন বাঘ বিধবা নারী রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জন বাঘ বিধবা নারীদের সহায়তার জন্য কাজ করছে লিডার্স। এরমধ্যে শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ও গাবুরা ১২০ জন এবং কয়রার বেতকাশি ইউনিয়নের ১৮০ জন। লিডার্সের তথ্য ও উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত এক দশক আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ৩০-৫০ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা যেক। তবে সম্প্রতি বন বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত কর্মতৎপরতা বৃদ্ধিতে বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্বে জীবনহানির ঘটনা কমছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০০ সালে বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন ৩০ জন, ২০০১ সালে ১৯ জন, ২০০২ সালে ২৮ জন, ২০০৩ সালে ২১ জন, ২০০৪ সালে ১৫ জন, ২০০৫ সালে ১৩ জন, ২০০৬ সালে ছয়জন, ২০০৭ সালে ১০ জন, ২০০৮ সালে ২১ জন, ২০০৯ সালে ৩২, ২০১০ সালে ৫০ জন, ২০১১ সালে ৪২ জন, ২০১২ সালে ২৯ জন, ২০১৩ সালে আটজন, ২০১৪ সালে চারজন মারা গেছেন। অন্য দিকে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে কেউ মারা যাননি। তবে এ দুই বছরে ১৩টি বাঘের আক্রমণের ঘটনায় দু’জন আহত হয়েছেন। ১২টি গবাদিপশু বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। ২০১৭ সালে বাঘের আক্রমণে দু’জন মারা গেছেন। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৪৫ জন বাঘের আক্রমণে দু’জন মারা গেছেন । বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এক দশক আগে প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ৩০ থেকে ৫০ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা যেত। এদের অধিকাংশ বাওয়ালী, জেলে, মৌয়ালী ও জ্বালানি কাঠ আহরণকারী। সরকার বন্যপ্রাণী দ্বারা নিহত বা আহত মানুষের জন্য ক্ষতিপূরণ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে এবং এর আলোকে ২০১১ সাল থেকে নিয়মিতভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। বাঘে আক্রান্তমানুষ সম্পর্কে উদাসীনতা লক্ষণীয়। তাদের অপয়া হিসেবে দেখা হয়। বাঘের আক্রমণে বেঁচে যাওয়া অথবা বাঘের হাতে মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারের পুনর্বাসন জরুরি।
পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন সুন্দরবনের বনজ সম্পদের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় সাতক্ষীরার উপকূলের লক্ষাধিক মানুষের। সম্প্রতি সময়ে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমনে প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কমেছে। তবে ভাল নেই উপকূলে বাঘের হামলায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্ত্রী বাঘ বিধবা নারীরা। অভাব অনাটন আর সমাজের নানা বঞ্চনা সহ্য করে বেঁেচ থাকতে হচ্ছে তাদের। খোঁজ নিয়ে যানা যায়, সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকুলীয় এলাকয় এক হাজারেরও বেশী বাঘ বিধবা নারী রয়েছে। অভাব অনাটন আর সামাজিক বঞ্চনা নিয়ে অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত প্রায় ১০০০ থেকে ১১০০ বাঘ বিধবা নারী। এসব বাঘ বিধবা নারীরা সাংসারিক কষ্টের পাশাপাশি মানুষিক ভাবে নিঘুত হচ্ছেন সমাজ থেকে।
সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন চকবারা গ্রামের বাঘ বিধবা নারী রাশিদা বেগম জানান, ৮/১০ বছর আগে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে যেয়ে বাঘের আক্রমনে নিহত হয় স্বামী আলম গাজী। স্বামীর রেখে যাওয়া শুধু কয়েক শতক জমির ভিটাবাড়িতে কোনো রকম মাথা গোজার মত করে ৪টি সন্তান নিয়ে খুবই কষ্টে বসবাস করেন। রাশিদা বেগম বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে এদিকে যেমন আর্থিক অনাটন আর অন্যদিকে সমাজের নানা ধরনের বঞ্চনা এবং কুসংস্কার নিয়ে অত্যন্ত মানবেতের জীবনযাপন করছি। শুধু তাই নয় স্বামীকে বাঘে ধরার খবর পাওয়ার পর থেকে তার পরিবারের লোকজনের মুখ থেকে আমাকে এখনো অপয়া অলক্ষি শুনতে হয়। তবে তিনি এখনও পর্যন্ত সরকারি কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি বলে জানান। একই গ্রােেমর বাঘ বিধবা নারী মুর্শিদা বেগম জানান, গত দুই বছর আগে সুন্দরবনে বাঘের হাতে নিহত হয় স্বামী রেজাউল ইসলাম। ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে ক্ষেত মজুরীর কাজ করে জীবনযাপন করছেন তিনি। মুর্শিদা জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর যে মানুষিক কষ্ট পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন সমাজের বঞ্চনা থেকে। স্বামীর আত্বীয়স্বজনের বাড়ি গেলে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কথাও বলতে চায় না। কারন আমারই কারণে বাঘে ধরেছে স্বামী রেজাউলকে। এরকম নানা ধরনের কুসংস্কার ও সামাজিক বঞ্চনা মাথায় নিয়ে দিন কাটছে আমার। তবে শুনেছি বৈধ পাশধারী কোনো বনজীবি বাঘের আক্রমনে নিহত হলে সরকার ক্ষতিপুরন দিচ্ছেন। কিন্ত আমি এখনো পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপুরন পাইনি। স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের এ্যাভোকেসি অফিসার পরিতোষ কুমার বৈদ্য জানান, সাতক্ষীরার সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলা শ্যামনগর ও কয়রা এলাকার বাঘ বিধবাদের নিয়ে কাজ করছেন তার সংস্থাটি। তিনি আরও বলেন, জলাবায়ু পরিবর্তনে ঝকিপূর্ণ জনগনের জীবন জীবিকা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প ২০১২ এর অধিনে বাঘ বিধবাদের বিভিন্ন প্রকার সহায়তা করা হয়। জার্মানির একটি দাতা সংস্থার সাথে স্থানীয় এনজিও লিডার্স প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ করছেন। আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটি চলবে বলে জানান তিনি।
পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারি বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম.কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী জানান, বৈধ পাশ নিয়ে সুন্দরবনে যদি কোনো মৌয়াল, জেলে বা বাওয়ালী বাঘের আক্রামনে নিহত হন তাহলে সরকার তাকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। একই সাথে কেউ আহত হলে তাকেও ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। বন্যপ্রাণীদ্বারা আক্রান্ত বিধিমালা ২০২১ এর অধিনে এই ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন সরকার। তবে এর আগে সরকারী সাহায্যের পরিমাণ ছিল কম। সরকারি আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি যে সমস্ত বাঘ বিধবা নারী রয়েছে তাদের বিনা মুল্যে পাশ দেয়া হচ্ছে। তারা যেন নদীতে মৎস্য আহরণের মাধ্যমে অন্তত কিছু উপার্জন করে সংসার নির্বাহ করতে পারে। তিনি আরও বলেন, অবৈধ উপায়ে যারা সুন্দরবনে মধু আহরণ বা মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয় তারা সরকারের এই সহায়তা পাবে না। আর যারা অবৈধ ভাবে বনে প্রবেশ করে বন্যপ্রাণীদের হাতে নিহত হয় সরকারী ভাবে সে সব মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
উপকূলীয় এলাকায় কিছু এনজিও সংস্থাও বাঘ বিধবাদের নিয়ে কাজ করছেন উল্লেখ করে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ হুমায়ুন কবির জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার যে সমস্ত অসহায় বাঘ বিধবা নারী রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পুনর্বাসনের জন্য জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
Check Also
সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ডের উদ্যোগে সভা অনুষ্ঠিত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি সাতক্ষীরা শহর শখার ২ নং ওয়ার্ড (রাজারবাগান ও সরকারপাড়া ইউনিট) এর উদ্যোগে …