বাংলাদেশিদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ নিয়ে নানান আলোচনা চলছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। দুর্নীতি-অর্থপাচার বা অবৈধ আয়ে বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রে যে সম্পদ গড়েছেন, তা জব্দ করা হতে পারে বলেও কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে। এরই মধ্যে দেশটিতে থাকা বাংলাদেশের সাবেক খাদ্য সচিব বরুণ দেব মিত্রের বিপুল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের একাধিক সূত্র।
যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতায় যুক্ত একাধিক প্রবাসী ঢাকা টাইমসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের আওতায় আরও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীর সম্পদ জব্দ করার প্রক্রিয়া চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীসহ বিভিন্ন সূত্র ঢাকা টাইমসকে জানায়, আয়ের বৈধ উৎস জানাতে না পারায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাবেক সচিব বরুণের যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বাড়ি ও সেদেশের ব্যাংকের যাবতীয় হিসাব জব্দ করা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত খোলাসা করে কিছু বলা হয়নি। কবে নাগাদ বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অবৈধ সম্পদের খোঁজে অভিযান শুরু হবে বা এ ধরনের অভিযান আদৌ হবে কি না সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি।
আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সাবেক ওই সচিবের সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ওই সূত্রগুলো বলছে, দেশটি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে সাবেক ওই সচিবের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। আরও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি সাবেক ও বর্তমান আমলার যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ‘অবৈধ সম্পদ’ বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে।
কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের অভিযান শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতায় যুক্ত একাধিক বাংলাদেশি। তারা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বেশকিছু বাংলাদেশির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে। এ বিষয়ক একটি তালিকাও দেশটির হাতে রয়েছে। যাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে অভিযান চালাবে দেশটি।’
এদিকে সাবেক ওই সচিবের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে অর্থপাচার করে অবৈধ উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তির মালিক হওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে। যারা মার্কিন ব্যাংকে টাকা রেখেছেন তারাও আতঙ্কে আছেন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কেউ কেউ ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে অন্যত্র সরানোর চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ সম্পদ বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে তা আদৌ সম্ভব হবে কিনা- তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।’
বরুণ দেব মিত্র ১৯৮২ ব্যাচের বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তা। ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে উত্তর আমেরিকাই আবাস গাড়েন তিনি। কখনো নিউইয়র্কে আবার কখনো কানাডার টরন্টোতে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের হিসাবের বরাত দিয়ে সূত্রগুলো বলছে, সেদেশে থাকা বরুণ দেব মিত্রের সম্পদের পরিমান কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা।
সূত্র বলছে, স্বেচ্ছা অবসরের পর সাবেক খাদ্য সচিব বরুণ পেনশনের টাকা উত্তোলনের আবেদনে নিজেকে অর্থকষ্টে থাকা গরীব অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তবে বরুণের স্ত্রী রাখি মিত্রের নামে নিউইয়র্কে তিনটি বাড়ি আর কানাডায় দুটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়। ২ মিলিয়ন ডলার নগদ পরিশোধ করে নিউইয়র্কের জ্যামাইকা এবং ফরেস্ট হিলে তিনটি বাড়ী কিনেছিলেন। আর কানাডার টরেন্টোতে ৩ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার দিয়ে কিনেছেন দুটি বাড়ি। নিউইয়র্কের তিনটি বাড়িই জব্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন।
সূত্র জানাচ্ছে, বরুণ দেব মিত্র ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের ৮৭-৩০/১৬৯ স্ট্রিট কুইন্স ঠিকানায় জনৈক নাসির আলী খান পলের কাছ থেকে প্রথম বাড়ীটি কেনেন। ৭৬ লাখ ডলার ব্যয়ে নগদ মুদ্রায় ওই বাড়ি কেনেন তিনি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
নিউইয়র্কের ৮৫-২৭/১৬৮ প্লেস, জ্যামাইকায় একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় বাড়ি কেনেন ৭ লাখ ৮৫ হাজার ডলার দিয়ে। ওই অর্থও নগদে পরিশোধ করা হয়। ২০১৮ সালের ১২ জুন নিউইয়র্কের ১১৩/৮১ এভিনিউ কিউ গার্ডেনস ঠিকানার তৃতীয় বাড়ী কেনেন। ইয়েলেনা সেডিনার কাছ থেকে বরুণ দেব মিত্র বাড়িটি কেনেন ৭ লাখ ৭৫ হাজার ডলারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডাতেও বিপুল ব্যয়ে বাড়ি কিনেছেন সাবেক এই খাদ্য সচিব। ২০১৭ সালের নভেম্বরে অবসর গ্রহণের মাত্র দুমাস পর কানাডার টরেন্টোতে কেনেন ১৪ লাখ কানাডিয়ান ডলারে একটি বাড়ি কেনেন তিনি। সবশেষ ২০১৯ সালে টরেন্টোতেই ৯ লাখ কানাডিয়ান ডলার দিয়ে কিনেছেন আরও একটি বাড়ি কিনেছেন বরুণ দেব মিত্র।
হবিগঞ্জে জন্ম নেওয়া সাবেক আমলা বরুণ দেব মিত্র বিডি মিত্র নামেও পরিচিত ছিলেন সহকর্মীদের কাছে। চাকরি জীবনে যেখানেই গেছেন সেখানেই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে।
সচিব থাকা অবস্থায় ২০১২ সালে নিম্নতম পদে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে ইকোনমিক মিনিষ্টার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। দুর্নীতির নানা অভিযোগের পরও তিনি সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছেন।