সাতক্ষীরায় সড়কের পাশে ৫ হাজার মরা গাছ, দুরর্ঘটনার শঙ্কা নিয়ে চলাচল করছে জনসাধারণ

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের পাশে লাগানো অসংখ্য রেইনট্রি গাছ মরে গেছে। অধিকাংশ মরা গাছে ছাল দেখা যাচ্ছে না। বহু বছরের মুল্যবান এসব গাছ এখন সড়কে ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জনসাধারনের জন্য। মাঝেমধ্যে শুকনো ডাল ভেঙে যানবাহন ও পথচারীদের গায়ে পড়তেও দেখা যায়। সড়কের পাশের মরা গাছ না কাটায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কার করছেন মানুষ। সামান্য ঝড়বৃষ্টি হলেই এসব গাছের ডাল ভেঙে পড়ে পথচারী ও যানবাহনের যাত্রীরা আহত হচ্ছেন। অথচ এসব গাছ দীর্ঘদিনেও কেটে ফেলার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। আশাশুনি-সাতক্ষীরা, বৈকারী-সাতক্ষীরা, ভোমরা-সাতক্ষীরা, ফিংড়ি-সাতক্ষীরা, মুন্সিগঞ্জ-সাতক্ষীরা ও যশোর-সাতক্ষীরা সড়কে এ চিত্র দেখা গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মারা গেছে আশাশুনি-সাতক্ষীরা সড়কে। জেলা পরিষদের কর্মকর্তারা জানান, কয়েক কোটি টাকা মূল্যের এসব মরা গাছ সড়ক থেকে অপসারণ করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। উদ্ভিদ বিষেশজ্ঞ ও পরিবেশবিদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন জনিতকারণে লবণাক্তরা বেড়ে যাওয়া, খাদ্য সংকট ও মাটির ক্ষার বাড়ায় এসব গাছ মারা যেতে পারে। সরকারি হিসাব মতে জেলার ৯টি সড়কের দুই পাশে ২০৭৮টি গাছ শুকিয়ে মরে গেছে। তবে বেসরকারি হিসাব মতে মরে যাওয়া গাছের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ ও স্থানীয় লোকজন প্রায় ২০ বছর আগে সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন সড়কের দুই পাশে কয়েক হাজার রেইনট্রিগাছ লাগায়। দুই বছর ধরে অধিকাংশ গাছ শুকিয়ে যেতে থাকে। সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ সূত্রে আরও জানায়, সাতক্ষীরা-চাঁদপুর সড়কের দুই পাশে ৩০৭টি, কদমতলা-বৈকারি সড়কের দুই পাশে ২২৭টি, কুল্যা-রমনগর সড়কের দুই পাশে ২০০টি, পাটকেলঘাটা-দোলুয়া সড়কের দুই পাশে ১৪৭টি, ঝাউডাঙ্গা-বালিয়াডাঙ্গা সড়কের দুই পাশে ২৭টি, নজিমগঞ্জ-নূরনগর সড়কের দুই পাশে ৪৫০টি, শ্যামনগর-কাশিমাড়ি সড়কের দুই পাশে ২৫০, শ্যামনগর-নওয়াবেঁকি সড়কের দুই পাশে ২০০, সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ সড়কের দুই পাশের ২৭০টি গাছ মরে গেছে।
সাতক্ষীরা জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জি এম মারুফ বিল্লাহ জানান, সড়কের পাশে রেইনট্রিগাছগুলো মরে যাচ্ছে। এ গাছ দ্রæত বাড়ে বলে একসময় সরকারি ও বেসরকারিভাবে সড়কের পাশে এ গাছ লাগানো হয়েছিল। দুই বছর ধরে সাতক্ষীরা জেলায় রেইনট্রিগাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। এ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের কয়েকজন গবেষক এসে মরা গাছের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালান। তাতে দেখা যায়, লাক্ষা পোকার আক্রমণে এসব গাছ মরে যাচ্ছে। লাক্ষা পোকার কারণে গাছ তার স্বাভাবিক খাদ্য সংগ্রহ করতে না পেরে আস্তে আস্তে মরে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, সাতক্ষীরায় রেইনট্রিগাছ লাগানো নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়ক ও সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ সড়কে দেখা গেছে, এই দুই সড়কের দুই পাশে বড় বড় রেইনট্রিগাছ শুকিয়ে মরে রয়েছে। সকালে বৃষ্টি শুরুহলে দুটি সড়ক দিয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যারা চলাচল করছে ভয়ে ভয়ে। সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করেন স্কুলশিক্ষক মিঠু বিশ^াস। তিনি জানান, সামান্য ঝড় কিংবা বৃষ্টি হলে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। দুই বছর ধরে চলছে এমন অবস্থা। বড় ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলেও ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ সড়ক দিয়ে যারা চলাচল করে, তারা ভয়ে ভয়ে চলাচল করে।
সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কের বাসিন্দা আবদুল হাই ও আশাশুনি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এস কে হাসান জানান, দুই বছরের বেশি সময় ধরে এ সড়কের কয়েক হাজার বড় বড় রেইনট্রিগাছ শুকিয়ে মরে গেছে। কিন্তু জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষকে বলা হলে এসব গাছ অপসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে দুই বছর কাটিয়ে দিয়েছে। কবে এসব গাছ অপসারণ করবে, তার ঠিক নেই। গাছ ভেঙে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
অতি সম্প্রতি এমনই এক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের মেল্লেকপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল খলিল হাজীর ছেলে ফারুক হোসেন। পবিত্র ঈদুল আজহার দিন সন্ধ্যায় আশাশুনি থেকে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কের কোমরপুরে একটি মরা শিশু গাছের (রেইন ট্রি) ডাল ডেঙে গায়ে পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এসময় ক্ষতিগ্রস্থ হয় তার মোটরসাইকেলটিও। স্থানীয়রা জানান, গাছগুলোর বয়স অনেক। রোগ বা পোকার আক্রমণে গাছগুলোর মারা যাচ্ছে। ডাল ভেঙে পড়ে চলাচলের বিঘ্ন ঘটছে। একটু বাতাস হলেই ডাল ভেঙে সড়কের ওপর পড়ে।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের অধীনে কমপক্ষে ৫ হাজারের অধিক রেইট্রি গাছ মারা গেছে। এসব গাছের মূল্য আনুমানিক তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা। দ্রæত এ সমস্ত গাছ অপসারণ করা হবে।
সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, মরা গাছগুলোর অধিকাংশ গাছ সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের। খুব কমসংখ্যক গাছ মারা গেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের।। তারপরও দ্রæত মুন্সিগঞ্জ সড়ক ও যশোর সাতক্ষীরা সড়কের মৃত বা ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হবে।
সাতক্ষীরার সামাজিক বনবিভাগের সহকারী বন রক্ষক নুরুন্নাহার বলেন, মরে যাওয়া গাছগুলোর বয়স কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ বছর হবে। গাছগুলো মরে যাওয়ার বিষয়ে বনবিভাগের গবেষণা কেন্দ্রে জানানো হয়েছে।
সাতক্ষীরা সরকারী কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগীয় প্রধান ড. নাসরিন আক্তার জানিয়েছেন, রেইনট্রি গাছ মরে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে মাটির লবণাক্তা ও ক্ষার বেড়ে যাওয়া। তাছাড়া প্রত্যেক গাছের আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট থাকে। রেইনট্রি গাছ মৌসুমী বৃষ্টিপাত না হলে তার মাটির খাদ্য সংকটে পড়ে। ফলে বিভিন্ন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তন জনিতকারণে রেইনট্রি গাছ মারা যেতে পারে। লবণাক্ততা বেড়ে মাটির উর্বররা শক্তি হারিয়ে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে গাছ মরে যেতে পারে।
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি সড়কের পাশে রেইনট্রিগাছ মরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যে বন বিভাগকে দিয়ে জরিপ ও মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে গেছে। দ্রæত সময়ে মধ্যে দরপত্রের মাধ্যমে মরা গাছগুলো অপসারণ করা হবে।

 

Check Also

প্রত্যেক উপজেলায় একটি সরকারি মাদ্রাসা করার সুপারিশ: সাতক্ষীরা ডিসি

ক্রাইমবাতা রিপোট,  সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেছেন, যদি প্রত্যেকটা উপজেলায় একটা সরকারি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।