আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: সুন্দরবনের খাল বা নদীর ধারে দল বেঁধে হরিণের চলাফেরার হরহামেশার দৃশ্য এখন চোখে পড়ছে না। সবুজের রাজ্যে সূর্যের কোমলতা-স্নিগ্ধতা আর কর্কশ-উষ্ণ রোদ্র পোহাতে আসা হরিণের বিচরণ কমে গেছে। কারণ সুন্দরবনে চলছে হরিণ শিকারের মহোৎসব। অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে এসব হরিণ শিকার করছে পাচারকারীরা। এতে একদিকে যেমন সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ হরিণ অস্তিত্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ হওয়ায় বনের ইকো সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের হরিণসহ সকল বন্য সম্পদ রক্ষায় আরও কঠোরভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে।
স্থানীয়রা বলছে, সুন্দরবন-সংলগ্ন উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় দাম কম হওয়ায় এই বন্যপ্রাণীর গোশতের চাহিদা বেড়েছে। এ সুযোগে গত কয়েক মাস ধরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরা-শিকারিরা। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে এসব চোরা-শিকারিদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়। বন বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে চোরা-শিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে ‘এজেন্ট ব্যবসায়ীদের’। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনো অগ্রিম, আবার কখনো গোশত এনেও বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছে যায় হরিণের গোশত। যাদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার কওে বন বিভাগ, গবেষক, বনজীবী থেকে শুরু করে বনসংশ্লিষ্ট সবাই সুন্দরবনে সাম্প্রতিক সময়ে হরিণের সংখ্যা বাড়ার কথা জানিয়েছেন। বন বিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবনে প্রায় ২ লক্ষাধিক হরিণ রয়েছে। বনের সর্বত্রই এর বাস। সাধারণত বনের কটকা, করমজল, দুবলারচর, হিরণপয়েন্ট, কচিখালী, সুপতি, ঢাংমারী এলাকায় হরিণের বেশি বিচরণ।
গত এক বছরে সুন্দরবনের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য হরিণশিকারিকে মাংসসহ আটক করা হয়েছে। বিভিন্ন অভিযানে আটক হরিণশিকারিদের তথ্য থেকে দেখা গেছে, বনের পাশে যাঁদের বাড়ি, তাঁরাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা এবং বাগেরহাটের মোংলা ও স্মরণখোলা উপজেলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করেন। ফাঁদসহ নানা কৌশলে সুন্দরবনে হরিণ শিকার করেন তারা। স্থানীয়দের অভিযোগ, শিকারিদের ধরতে সুন্দরবনে বন বিভাগের নিয়মিত টহল থাকলেও অদৃশ্য কারণে হরিণ শিকার কমছে না। বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে, আবার কখনও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে শিকারিদের সুযোগ করে দিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা শিকারি চক্রের কাছ থেকে হরিণের মাংসসহ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করায় দিনে দিনে সুন্দরবনে হরিণ শিকার বাড়ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, সুন্দরবনকে নিরাপদ করতে ২০১২ সালে টাস্কফোর্স গঠনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল অনেক বেড়েছে। এতে বনে অপরাধ অনেক কমে এসেছে। হরিণ শিকারের অন্যতম উৎস ছিল জলদস্যুরা। মূলত তাঁরাই হরিণ শিকার করে খেতেন। কিন্তু সুন্দরবন এখন বনদস্যুমুক্ত হওয়ায় হরিণ শিকার অনেক কমে গেছে। এখন সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। এটা সুন্দরবনের জন্য সুখবর। তবে বন কর্মকর্তাদের দাবি, হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। র্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে হরিণ শিকারের সুযোগ কম। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও সেটা আগের চেয়ে তুলনামূলক অনেক কম। শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এখন মাংসসহ হরিণশিকারি বেশি ধরা পড়ছেন বলে জানান তাঁরা। হরিণের সংখ্যা বাড়ার আরেকটি কারণ হিসেবে আবু নাসের বলেন, সুন্দরবনে রাসমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হরিণ শিকার কমেছে। বছরের শেষের দিকে সুন্দরবনের দুবলার চরে অনুষ্ঠিত রাসমেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ সেখানে আসতেন। অল্প লোকবল দিয়ে এত মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হতো না। এ কারণে ওই সময় বিপুল পরিমাণ হরিণ শিকার করা হতো। কিন্তু তিন বছর ধরে বন বিভাগ মেলার ব্যাপ্তি কমিয়েছে। এখন শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই রাসমেলায় যেতে পারেন। ফলে অল্প মানুষকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, এখন সুন্দরবনে গেলেই হরিণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে ছিল না। এটা সুন্দরবনের জন্য সুখবর। হরিণের সঙ্গে বাঘও দেখতে পাচ্ছেন পর্যটকেরা। সুন্দরবন আগের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছে, এটাই তার প্রমাণ। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘সম্প্রতি সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার বিধিমালা-২০২০ অনুমোদন হয়েছে। এর ফলে এখন চোরা শিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য প্রদানে উৎসাহিত হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে তথ্য প্রদানকারীকে ৫০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে বাঘের চামড়াসহ আটক করার তথ্য প্রদানকারীকে ২৫ হাজার টাকা, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে হরিণের চামড়াসহ আটক করার সহায়তাকারীকে ২০ হাজার টাকা ও সুন্দরবনের বাইরে হরিণের চামড়াসহ আটক করায় সহায়তাকারীকে ১০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তথ্য প্রদানকারীর নিরাপত্তা ও তথ্য গোপন রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, ‘সুন্দরবনে বন্যপ্রাণী শিকার বাড়েনি। আগে বণ্যপ্রাণীর অংশ বিশেষ উদ্ধার হতো। আসামি আটক হতো না। এখন পুরস্কার ঘোষণার কারণে বন্যপ্রাণীর অংশসহ আসামি আটক হচ্ছে। এ কারণে মনে হচ্ছে বন্যপ্রাণী শিকার বেড়েছে। আসলে নতুন বিধিমালার পর মানুষের সচেনতা বেড়েছে। তাই হরিণের মাংসসহ আটকের মাত্রা বেড়েছে।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …