১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত
আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারায় উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস অনুপযোগী হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তালিকায় ওপরের দিকে সাতক্ষীরাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চল । প্রতিবছর এ অঞ্চলে নতুন নতুন দুর্যোগ আসছে এবং তীব্রতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দুই দশকে এ ভূখন্ডে ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের হিসেবেই পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হয়ে ছিল। কিন্তু বেসরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে দশ লাখ। কারণ দুর্যোগ প্রশমনে দেশে যুগোপযোগী উদ্যোগের ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভুক্তভোগীদেও সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমতা আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তাঁরা। এমন বাস্তবতায় গতকাল ১৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালিত হয়েছে। ‘অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই করি, দুর্যোগ সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি’ এমন প্রতিপাদ্য নিয়ে সারাদেশের ন্যায় সাতক্ষীরাতেও গুরুত্বের সাথে দিবসটি পালিত হয়েছে। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস’ উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
দক্ষিণাঞ্চলে পরিবেশ ও দুর্যোগঝুঁকি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিচ টু আনরিচডের (রান) প্রধান নির্বাহী রফিকুল আলম বলেন, ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর দেশি-বিদেশি সহায়তায় এই এলাকার দুর্যোগ প্রশমনে বেসরকারি সংস্থাগুলোর যেসব প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, এখন তা আর নেই। কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। তা চলমান রাখা প্রয়োজন। তার মতে ঘূর্ণিঝড়–সংক্রান্ত আবহাওয়া বিভাগের প্রচারিত সংকেত নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি রয়েছে মানুষের মধ্যে। এতে দুর্যোগে ঝুঁকি বেড়ে যায়। সমদ্রগামী জেলেদের কাছে রেডিও থাকলেও গভীর সমুদ্রে তা কাজ করে না। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সাতক্ষীরা জেলার ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি বললেন, শ্যামনগর থেকে ৪০-৫০ মাইল গভীর সাগরে গেলেই জেলেদের রেডিও আর কাজ করে না। এমনকি মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করে না। ফলে প্রতিবছর বহু জেলে প্রাণ হারান।
সূত্রমতে, ১৯৭৪ সালের ২৪-২৮ নভেম্বর উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ তীরবর্তী দ্বীপসমূহে জলোচ্ছ্াসে ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৮৩ সালের ৫-৬ নভেম্বর উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে তিনশত মৎস্যজীবী নিখোঁজ হন এবং দুই হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। ১৯৮৬ সালের ৮-৯ নভেম্বর উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ্ঝড়ে ১৪ ব্যক্তি নিহত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪-৩০ নভেম্বর সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহ এবং খুলনা বরিশালের চরাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়্রা ঘূর্ণিঝড়ে পাঁচ হাজার ৭০৮ ব্যক্তি নিহত হন। এবং ৬৫ হাজার গবাদিপশু মারা যায়। বহু সংখ্যক বন্যপশু মারা যায়। তার মধ্যে ছিল হরিণ ১৫ হাজার ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯টি এবং ফসল নষ্ট হয় প্রায় ৯৪১ কোটি টাকার। ১৯৯৫ সালের ২১-২৫ নভেম্বর উপকূলবর্তী দ্বীপসমূহে এবং কক্সবাজারের চরাঞ্চলে ঘণ্টায় ২১০ কিমি. বেগে বাতাসের গতিতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে প্রায় ৬৫০ জনের মৃত্যুু ও ১৭ হাজার গবাদিপশুর প্রাণহানি ঘটে।২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সুপার সাইক্লোন সিডর আঘাত হানে। এতে সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও পিরোজপুর জেলা এই সাইক্লোনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে ৩ হাজার ৪০৬ জন লোক নিহত হয়, নিখোঁজ হয় এক হাজার তিনজন, মারাত্মক আহত হন ৫৫ হাজার। তবে বেসরকা-রি হিসাবে এ সংখ্য আরো বেশি।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এখনো অনেকটা ত্রাণকেন্দ্রিক। দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসের এই সংস্কৃতি এড়ানো প্রয়োজন এবং এই প্রচেষ্টায় উন্নয়ন ও আর্থিক বৈষম্য দূর করে সমতা আনার মতো বিষয়গুলোর সন্নিবেশ করা প্রয়োজন। দুর্যোগ হ্রাস বা প্রশমনের জন্য সরকারের নীতিগুলো সমন্বয়; দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বস্তরে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিশ্চিত করা; দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমন্বয়; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর মাধ্যমে নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং নাগরিকদের আর্থিক সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগঝুঁকি প্রশমন করা সম্ভব।
প্রতিবছর এক বা একাধিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ভাঙাচোরা অববাঠামো আরও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এতে করে উপক‚লবাসী জীবন-জীবিকা এবং মূল্যবান অবকাঠামো হুমকির মুখে রয়েছে। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়সহ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ¡াসে দেশের বাঁধের বেশিরভাগ অংশ নাজুক হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র সুপার সাইক্লোন সিডরে উপকূলীয় ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্থ হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্থ হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এপর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুযোর্গ সমূহ হলো- ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালের ১৬ মে মহাসেন, ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই কোমেন, ২০১৬ সালের ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালের ৩০ মে মোরা, ২০১৯ সালের ৩ মে ফণি, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সূত্রবলছে, বর্তমানে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবেলায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিতে (সিপিপি) ৭৬ হাজার ১৪০ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছেন। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার ফলে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ব্যবস্থাপনায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরকারের নীতি-পরিকল্পনায় এরই মধ্যে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কৌশল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আগাম সতর্কবার্তা প্রচার ব্যবস্থা শুরু হয়। সিপিপিকে সরকার শক্তিশালী করার লক্ষ্যে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে এখনো যানবাহন, অবকাঠামো ও লোকবলসংকট আছে।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …