১৬ অক্টোবর বিশ্ব-খাদ্য-দিবস- উপকূলে খ্যাদ্য নিরাপত্তায় ভূগছে ৫ কোটি মানুষ

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের পাশাপাশি খ্যাদ্য নিরাপত্তায় ভূগছে। বৈরী প্রতিকূলতা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবী মানুষকে। জাতীয় অর্থনীতি জিডিপিতে তাদের কম-বেশি প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান। বিপুলসংখ্যক মৎস্যজীবী সমদ্র নদীতে মাছ ধরে তারা জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বড় অংশীদার বলছেন, বিশেজ্ঞরা। এদিকে গত ৩০ বছর লবণ পানি ও চিংড়ি চাষের বিরূপ প্রভাবে সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ কারণে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ৬০ প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি । চরম হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন। গাছ-পালা না থাকায় পরিবেশের বিপর্যয়সহ হুমকির মুখে পড়েছে জীব বৈচিত্র। কর্মসংস্থানের অভাবে গত এক দশকে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে হাজারো শ্রমজীবী। চিংড়ি বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ১৬ অক্টোবর রোববার দুর্ভিক্ষের-শঙ্কার-মধ্যে-বিশ্ব-খাদ্য-দিবস-পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ন্যায় উপকূলীয় অঞ্চল সমূহে গুরুত্বের সাথে দিবসটি পালিত হবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রæত স্বাভাবিক না হলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে।

এক সময়ের কৃষি অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের নদ- নদীগুলোতে ষাটের দশকে তৎকালীন সরকার পানিউন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে এ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে বিল্পব ঘটে। সবুজ গাছপালায় উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় মিনি অরণ্য। প্রতিটি বাড়ির গোয়ালে ছিল গরু, ‘গোলা ভরা ধান ও পুকুর ভরা মাছ। এলাকার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। কালের বিবর্তনে ৮০’র দশকে এ অঞ্চলের কৃষি জমিতে লবণ পানি উত্তোলন করলে শুরু হয় পরিবেশ বিধ্বংসী চিংড়ি চাষ । প্রথম দিকে ধান এবং মাছের উৎপাদন ভাল হওয়ায় এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি প্রভাবশালী ঘের মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং ঘের মালিকরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় ধান চাষ বন্ধ করে জমিতে সারা বছর লবণ পানি ধরে রেখে শুধুমাত্র চিংড়ি চাষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বর্তমানে উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা, আশাশুনি, প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর কৃষি জমিতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে । প্রভাবশালী ঘের মালিকরা এসব চিংড়ি ঘেরে ধান চাষের সুযোগ না দেওয়ায় বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারী কৃষকরা। দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তিপত্রের কাছে জিম্মি হয়ে আয়ের উৎস না থাকায় কয়েক বছরের হারির টাকা অগ্রিম নিয়ে খরচ করে অভাব অনাটনের কারণে অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার তাদের জমি বিক্রি করে ভূমিহীন হয়েছেন।

অপরদিকে, একই জমিতে দীর্ঘদিন চিংড়ি চাষের ফলে মাটি ও পানির সকল গুনাগুন নষ্ট হওয়ায় চিংড়িতে দেখা দিয়েছে ভাইরাসসহ নানাবিধ রোগ বালাই। সম্প্রতি ভাইরাসের কারণে বিনিয়োগকৃত মূলধন ফেরত না আসায় ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছে অনেক চিংড়ি চাষী । এছাড়া, লবণ পানির প্রভাবে ধান চাষ ব্যাহত হওয়ায় গত দু’দশক ধরে এ অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে । জেলা কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক বলেন, বছরের পর বছর উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি জমি লবণ পানিতে তলিয়ে রাখায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদুর ভবিষ্যতে ফসলের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে যাবে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে।

বর্তমানে উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা, আশাশুনি, খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রূপসা এবং বাগেরহাটের শরণখোলা, রামপাল, মোড়েলগঞ্জ, মংলায় প্রায় দেড় লাখ হেক্টর কৃষি জমিতে লবণ পানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমিয়েছেন। আভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও পানি নিস্কাশনের সরকারি খালগুলো বাঁধ দিয়ে চিংড়ি চাষের ফলে পলি পড়ে অধিকাংশ নদ-নদী ও খাল ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। চলতি বছর সাতক্ষীরাসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা স্থায়ি জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা বিশ্বকে চরম খাদ্য সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। নতুন করে ই¯্রাইল ও ফিলিস্থিনে যুদ্ধের কারণে আরও এক দফা খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠে ৯ শতাংশের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে।

এদিকে বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরায় কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন দাবিতে সাতক্ষীরা জেলা সদরের শহরতলির বাটকেখালি এলাকায় গতকাল সকাল ৯টার দিকে এই কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে কৃষাণ ও কৃষাণিরা বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্লাকাড ও ব্যানার বহন করে। এ সময় কৃষকরা খাদ্য দিবসের দাবিসমূহ: প্লাকাড ও ব্যানারে তুলে ধরেন। এ বছর দিবসটির প্রতিবাদ্য হচ্ছে ‘পানিই জীবন, পানিই খাদ্য, কাউকে বঞ্চিত করা হবে’। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্বদেশ-সাতক্ষীরা, উপক‚লীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন) ও বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রæপ অন ইকোলোজি এন্ড ডেভেলপমেন্ট (বিডবিøউজিইডি)’র উদ্যোগে সাতক্ষীরায় কৃষক সমাবেশের আয়োজন করে। কৃষক সমাবেশে কৃষক ও কৃষাণিরা উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারা দেশে খাদ্য নিরাপত্তার দাকী জানান।

 

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।