হুমকির পর মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে তুলে এমপি মনসুরের বাসায় নিয়ে মারধর

একদিন আগেই এমপি ডা. মনসুর রহমান মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে ঘাড় পাকিয়ে তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন ফোনে। কথামতো ঠিক একদিন পরেই তার ক্যাডাররা রাজশাহীর পুঠিয়ার বিড়ালদহ সৈয়দ করম আলী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানকে তুলে নিয়ে রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ডা. মনসুরের রাজশাহী নগরীর কাজিহাটার বাসায় নিয়ে যান। তিন ঘণ্টা আটকে রেখে তাকে মারধর করা হয়।

এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করলে তিন ঘণ্টা পর এমপির বাসা থেকে পুলিশ অপহৃত মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে উদ্ধার করেন। সোমবার দুপুরে পুঠিয়ার বিড়ালদহ এলাকায় ঘটে চাঞ্চল্যকর অধ্যক্ষ অপহরণের এ ঘটনা।

এদিকে অধ্যক্ষকে তুলে আনার হুমকি দেওয়া সংক্রান্ত এমপি ডা. মনসুরের একটি অডিও ক্লিপ ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে।

অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমানকে উদ্ধারের দাবিতে সোমবার সকালে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অবরোধ করেন। ঘটনার তিন ঘণ্টা পর অধ্যক্ষকে এমপির বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। অধ্যক্ষ অপহরণের ঘটনাটি রাজশাহীতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এলাকাতেও।

এলাকাবাসী, মাদ্রাসার শিক্ষক ও অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্টরা অভিযোগে বলেন, সম্প্রতি সৈয়দ করম আলী ফাজিল মাদ্রাসার নতুন কমিটি গঠন করেন অধ্যক্ষ। এতে এমপি ডা. মনসুরের সুপারিশকৃত রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলীকে সভাপতি না করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারার অনুসারী আব্দুল সালেককে সভাপতি করা হয়। এ নিয়ে রাজশাহী-৫ আসনের বর্তমান এমপি ডা. মনসুর রহমান ও সাবেক এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারার সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে উঠে। এতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের ওপর ব্যাপক ক্ষুব্ধ হন এমপি মনসুর। তাকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন ফোনে।

অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান অভিযোগে বলেন, মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নতুন কমিটি গঠন করি। এতে এমপি ডা. মনসুর রহমান আমার প্রতি ক্ষুব্ধ হন। শনিবার রাত ৯টায় তিনি ফোন করে আমাকে বলেন, এখনই আমার বাসায় আসেন। আমি তাকে জানাই, আমি তো পাবনায় গ্রামের বাড়িতে আছি। ফিরব রোববার ভোরে। তখন এমপি সাহেব বলেন, তাহলে কাল রাতে আসেন। আসতে পারবেন তো? না আসতে পারলে ঘাড় পাকিয়ে তুলে আনব কিন্তু। মনে থাকে যেন।

অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‌‌‌এরপর সোমবার সকাল ৯টায় এমপি ঘনিষ্ঠ শফিকুল ইসলাম ডাবলু, মুহিন, তুষারসহ পাঁচজন মাদ্রাসায় আসেন। কথা আছে বলে বাইরে আসতে বলেন। তারা আমাকে জোর করে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেন। এ সময় তারা আমাকে বেধড়ক কিলঘুসি লাথি মারতে থাকেন। তারা মারতে মারতে আমাকে এমপির রাজশাহী শহরের কাজিহাটার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর এমপি সাহেব মাদ্রাসার কমিটি নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

শাসানি দেওয়ার একপর‌্যায়ে এমপি সাহেব আমাকে বলেন- আপনাকে তুলে আনাটা ঠিক হয়নি। মুহিন নামের এক ক্যাডারকে দিয়ে লোকদেখানো আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ানো হয়।

অধ্যক্ষ বলেন, অপহরণ ও মারধরের ঘটনায় মামলা করব কিনা স্থানীয় লোকজন, অভিভাবকসহ এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।

এদিকে অধ্যক্ষকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী অভিভাবক ও এলাকাবাসী রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন। তারা সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে অধ্যক্ষকে দ্রুত উদ্ধারের আশ্বাস দিলে তারা অবরোধ তুলে নেন। তুলে নিয়ে যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুঠিয়া থানা পুলিশ মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে গাড়িতে করে নিয়ে মাদ্রাসায় পৌঁছে দেন। পুঠিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি রফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অন্যদিকে মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে ক্যাডার দিয়ে তুলে এনে ও মারধরের অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজশাহী-৫ আসনের এমপি ডা. মনসুর রহমান বলেন, অধ্যক্ষকে তিনি বাসায় ডেকেছিলেন। তুলে আনা হয়নি।

তিনি বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলীকে আমি বিড়ালদহ মাদ্রাসার সভাপতি করেছিলাম; কিন্তু অধ্যক্ষ মেয়াদ শেষে তাকে আবার সভাপতি না করে সাবেক এমপি দারার একজন লোককে সভাপতি করেন। এজন্য কথা বলতে তাকে ফোন দিয়েছিলাম। আমার লোককে সভাপতি না করায় এলাকার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষকে আমার বাসায় এনেছিল বলে স্বীকার করেন তিনি। পরে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে থানা পুলিশকে বাসায় ডেকে তাদের সঙ্গে তাকে আবার মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।

অধ্যক্ষকে ঘাড় ধরে তুলে আনার হুমকির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, এ ধরনের হুমকি আমি দিইনি। এসব দারার কারসাজি।

এদিকে বিড়ালদহ সৈয়দ করম আলী ফাজিল মাদ্রাসার নতুন সভাপতি আব্দুস সালেক বলেন, আমি আমার যোগ্যতায় সভাপতি হয়েছি; কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সামনে দিয়ে প্রকাশ্যে অধ্যক্ষকে টেনেহিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া খুবই ন্যক্কারজনক একটি ঘটনা। এ ঘটনায় জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি। আমরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছি। এরপর অধ্যক্ষকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনার বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুর রহমান বলেন, সংসদ সদস্য ডা. মনসুর সাহেব মাদ্রাসা অধ্যক্ষকে বাড়িতে ডেকেছিলেন। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Please follow and like us:

Check Also

খুলনায় ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে পানি ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ

খুলনায় প্রখর তাপদাহে ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থী ও পথচারীদের মাঝে  পানি ও খাওয়ার স্যালাইন বিতরণ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।