শফিকুল ইসলাম সাতক্ষীরা থেকে ফিরে: অনেকটা শখের বশে ২০১৪ সালে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেছিলেন সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মোড়ল আবদুল মালেক। মাত্র তিনটি চাড়ি নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন তিনি। আট বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা বেড়ে ৩০০ চাড়িতে পৌঁছেছে। প্রতি দেড় মাসে এখন পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ২০ মেট্রিক টন কেঁচো ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার, আর তাতে আবদুল মালেকের আয় হচ্ছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
তবে কেঁচো সার উৎপাদনে মোড়ল আবদুল মালেকের পথচলা শুরুতে এতটা মসৃণ ছিল না। এ নিয়ে তাঁকে শুনতে হয়েছে অনেক কটুকথা। আর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় চ্যালেঞ্জও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন আবদুল মালেক।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত এই মাঠকর্মী কেঁচো সারের বিষয়ে প্রথম জানতে পারেন স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে। নিজস্ব পাটখেতের জমি প্রস্তুত করার সময় ব্যবহার করেন কেঁচো সার। এতে খরচ যেমন কম লাগে, তেমনি ফলনও ভালো হয়। পরের মৌসুমে এক বিঘা ধানের জমিতে এই সার ব্যবহার করেন। এবারও যথারীতি ভালো ফলন পেলেন।
আবদুল মালেক তখন ভাবলেন, কেঁচো সার না কিনে নিজে তৈরি করলেই খরচ অনেক কমে যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ছুটে গেলেন জেলা কৃষি অফিসে। কর্মকর্তার কাছ থেকে ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার উৎপাদনের প্রক্রিয়া জেনে নিলেন।
পরীক্ষামূলক উৎপাদনের পর তিনি মাত্র ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ২০টি চাড়িতে কেঁচো সার তৈরি শুরু করেন।
কেঁচো সারের মূল উপকরণ গরুর গোবর ও কেঁচো। এ জন্য যথারীতি কৃষি অফিস থেকে কেঁচো এবং স্থানীয়ভাবে গোবর সংগ্রহ শুরু করে দিলেন আবদুল মালেক। কিন্তু তাঁর এ কাজ দেখে উপহাস করতে শুরু করেন প্রতিবেশীরা। কেউ তাঁকে পাগল বলতেন, আবার কেউবা ডাকতেন ‘কেঁচো মালেক’ নামে। কিন্তু তাঁর কাজে উৎসাহ দিয়ে পাশে ছিলেন স্ত্রী ও একমাত্র মেয়ে।
২০১৮ সাল পর্যন্ত ছোট পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল আবদুল মালেকের কোঁচো সার তৈরির কাজ। পরের বছর উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাঁর এই উদ্যোগের পরিসর বাড়াতে এগিয়ে আসে। উন্নয়ন প্রচেষ্টা কাজটি করেছে বিশ্বব্যাংক ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) যৌথ উদ্যোগ—সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্টের (এসইপি) আওতায়। উন্নয়ন প্রচেষ্টা থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদনের পরিধি বাড়ান তিনি।
তালা উপজেলার জিয়ালা গ্রামে দুগ্ধ খামারিদের নিয়ে এসইপির একটি উপপ্রকল্প রয়েছে। সেখানে দুগ্ধ খামারিরা পরিবেশসম্মত উপায়ে গোবর সংগ্রহ করেন। মোড়ল আবদুল মালেক তাঁর সারের জন্য প্রয়োজনীয় গোবর আনতেন সেখান থেকেই। চার বছরের ব্যবধানে এখন তাঁর চাড়ির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩০০টি। প্রায় চার বিঘা জমি ব্যবহার করে তিনি এ কাজ করছেন। কেঁচো সার ছাড়াও ট্রাইকো কম্পোস্ট সারও তৈরি করছেন তিনি।
আবদুল মালেক জানান, কেঁচো সার তৈরিতে তেমন কোনো ঝামেলা নেই। একটি নির্দিষ্ট চাড়ি বা চৌবাচ্চায় গোবরের মধ্যে কেঁচো রেখে দিলেই হয়। প্রায় ৪০ দিন পরে কেঁচো সব গোবর খেয়ে উপজাত হিসেবে সার তৈরি করে। এক বস্তা গোবর থেকে প্রায় ১৫ কেজি কেঁচো সার তৈরি হয়। তবে ট্রাইকো কম্পোস্ট তৈরিতে বেশি শ্রম লাগে। এতে গোবর ছাড়াও কচুরিপানা, চা–পাতা, খইল, মুরগির বিষ্ঠা, নিমপাতা, চিটাগুড়, ভুট্টার গুঁড়া ইত্যাদি উপকরণ যুক্ত করতে হয়। এটিও প্রস্তুত হতে ৪০ দিনের মতো সময় লাগে।
বর্তমানে প্রতি দেড় মাসে ১০ টন করে মোট ২০ টন ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সার তৈরি হচ্ছে আবদুল মালেকের খামারে। ফসলের জমি ছাড়াও মাছের ঘেরের জমি প্রস্তুত করা, পানের বরজ, ছাদবাগান ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয় এসব জৈব সার। প্রতি টন ভার্মি ১৫ হাজার টাকা এবং ট্রাইকো ১০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়। তাতে প্রতিবারে তাঁর আয় হয় আড়াই লাখ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০ হাজার টাকার বেশি মুনাফা থাকে। তাঁর প্রতিষ্ঠানে এখন কর্মী আছেন পাঁচজন।
এদিকে আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবদুল মালেকের সুদিন ফিরেছে সামাজিকভাবেও। তাঁর মেয়ে শাহীনূর ইয়াসমিন বলেন, যাঁরা বেশি করে বাবাকে ‘কেঁচো মালেক’ ডাকতেন, তাঁরাই এখন বাবার কাছে কেঁচো সার তৈরির পরামর্শ নিতে আসেন। শাহীনূর ইয়াসমিন নিজেও বাবাকে কাজে সহযোগিতা করেন। শ্বশুরবাড়ি কাছে হওয়ায় সমস্যা হয় না তাঁর। শাহীনূর বলেন, ‘এ কাজের মাধ্যমে আমি শ্বশুরবাড়িতেও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে পারি।’
নিজের উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন আবদুল মালেক। এসএস অ্যাগ্রো ভার্মি কম্পোস্ট নামে নিয়েছেন ব্যবসার নিবন্ধন (ট্রেড লাইসেন্স)। পিকেএসএফ ও উন্নয়ন প্রচেষ্টার সহায়তায় পরিবেশ ছাড়পত্রসহ কয়েকটি প্রয়োজনীয় সনদও পেয়েছেন তিনি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন আসছেন তাঁর উদ্যোগ দেখতে। আর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে।
জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোগকে আরও বড় করতে চান মোড়ল আবদুল মালেক। তবে এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা দুটি। এক. এত দিন তিনি অ–আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প ঋণ নিয়ে কাজ করেছেন। আবদুল মালেকের কথায়, ‘আমার আরও বড় ঋণ প্রয়োজন। কিন্তু কেঁচো সারের খামারে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চায় না।’ দুই. বাজারে কেঁচো সার নিয়ে প্রচারণা কম। এ কারণে বেশিসংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছানো কষ্টকর হচ্ছে। এ ছাড়া ওই এলাকার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের সহযোগিতা চান আবদুল মালেক।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রচেষ্টার কর্মকর্তা ও এসইপি ডেইরি ফার্ম প্রকল্পের ফোকাল পারসন শাহনেওয়াজ কবির বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশসম্মত দুগ্ধখামার ও জৈব সারের উদ্যোক্তা বানানোর পাশাপাশি আমরা একটি টেকসই ভ্যালুচেইন তৈরির চেষ্টা করেছি। ফলে দুগ্ধখামারি, জৈব সারের উদ্যোক্তা এবং এসব পণ্যের সাধারণ ভোক্তা— সবাই লাভবান হচ্ছেন।’