আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: সুপেয় পানির তীব্রসংকটে ভুগছে সাতক্ষীরাসহ উপকূলবাসী। পৌরসভা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি উপজেলায় একই চিত্র। লবণাক্ততা, আর্সেনিক ও আয়রনের প্রভাবে সুপেয় পানির চরম সংকটে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে সাতক্ষীরা জেলার লাখ লাখ মানুষের। খাবার পানি সংগ্রহে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিতভাবে ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন এবং লবণাক্ততার সমস্যা দূর করতে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যেসব উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে সেগুলো তদারকি না করার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের জেলা পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ, খুলনার ২২ শতাংশ এবং বাগেরহাটের ১৫ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এই তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ বলছেন পরিবেশবাদীরা। এমন পরিস্থিতিতে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি বাড়ছে দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব। ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) জরিপের ফলাফল অনুযায়ী,সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় বসবাসকারী ৭৩ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ লবণাক্ত পানি পান করছেন। এদিকে উপকূলীয় সকল মানুষের জন্য নিরাপদ পানির দাবিতে গতকাল সাতক্ষীরায় আলোচনা সভা ও মানববন্ধন করেছে কয়েকটি সংগঠন।
আলোচনায় অংশগ্রহনকারী বক্তারা বলেন, কৌশলগত পরিকল্পনার দূর্বলতায় দেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলায় মানুষের সুপেয় পানির অধিকার নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন গিয়াস উদ্দীন সরদার, তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের জন্য পানির কোনো-না-কোনো উৎস থাকলেও নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ। গত কয়েক দশকে জন প্রতি মিঠাপানির পরিমাণ ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং দূর্বল ব্যবহার ব্যবস্থাপনা, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির প্রাপ্যতা এবং গুণমান দ্রæত অবনতি হচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগন বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষক, নারী, শিশুরা নিরাপদ পানির সংকটে জর্জরিত, যারা ইতোমধ্যেই তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর চ্যালেঞ্জ এর সম্মুখীন।
জানা যায়, ২০০৯ সালে আইলা এবং তারও আগে সিডরের তান্ডবের পর থেকে এসব উপকূলীয় এলাকার সুপেয় পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে যায়। সমস্যার সমাধানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পুকুর খনন, নলকূপ স্থাপন, লবণ পানি পরিশোধন যন্ত্র- পন্ডস অ্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) স্থাপন এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের মত প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও তেমন সুফল মেলেনি। মেরামত ও সংরক্ষণ না করায় এরিমধ্যে অধিকাংশ পিএসএফ নষ্ট হয়ে পড়েছে।
২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক জরিপ মতে উপকূলীয় উপজেলার মানুষের প্রতি লিটার খাবার পানিতে ১৫০০-২৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রাম। এর বেশি লবণাক্ততা থাকা মানে তা খাওয়ার অনুপযোগী। আবার চিংড়ি ঘেরে উঁচু বাঁধ না দেয়ায় সেখানকার লবণাক্ত পানি পুকুরে ঢুকে পড়ছে এবং সেই পানি আর খাওয়ার উপযোগী থাকছে না। এমন অবস্থায় পুকুর নিয়মিত খননের পাশাপাশি লবণ পানি শোধনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের জেলেখালী গ্রামের গৃহবধূ নিলা রানী (৩০) ও দিপা রানী (২৮) বলেন, ‘আমাদের গ্রামসহ আশাপাশের গ্রামে সুপেয় পানির সংকট তীব্রআকার ধারণ করেছে। এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা দরিদ্র। তাদের নিরাপদ পানি কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই জীবনধারণ করতে গ্রামের নারীরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন। এতে আমাদের গৃহস্থালি কাজ ব্যাহত হয়।’ তারা জানান, শুধু জেলেখালী গ্রামই নয়, পাশের ধুমঘাট, মুন্সিগঞ্জ, যতীন্দ্র্রনগর, ভৈরবনগর, আড়পাংশি, হরিনগরসহ অনেক গ্রামের মানুষ সুপেয় পানির কষ্টে রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা জলবায়ু অধিপরামর্শ ফোরামের সভাপতি ও শিক্ষাবিদ আব্দুল হামিদ বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে নারীদের ক্ষেত্রে খিঁচুনি, জরায়ুর সমস্যাসহ গর্ভবতী নারীদের বিবিধ ঝুঁকি বাড়ছে। দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টা ব্যয় হচ্ছে, আবার নিপীড়নের শিকারও হচ্ছেন অনেকেই। তিনি আরো বলেন, দেশের ৯৮-৯৯ শতাংশ মানুষ সাধারণভাবে পানির সুবিধা পেলেও গুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি এখনো সবার জন্য নিশ্চিত করা যায়নি। সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক ও ফোরামের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। এরই মধ্যে সাতক্ষীরায় বিশুদ্ধ খাবার পানির দুষ্প্রাপ্যতা তৈরি হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘জেলার উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে অন্তত ১৫ হাজার পরিবারের পানির চাহিদা মিটবে। এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুর æহয়েছে। তবে চাহিদার কথা বিবেচনা করে আগামীতে প্রকল্প আরো বাড়ানো হতে পারে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ন কবির বলেন, উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে জলোচ্ছ¡াস ও বেড়িবাঁধ ওভারফ্লো হয়ে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সময়মতো টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যায় না। এরকম একটা সংকট আমাদের এখানে রয়েছে। এটা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার যথেষ্ট আন্তরিক এবং ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চলছে। তিনি বলেন, আমাদের রেইন ওয়াটার হারভেস্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পট এবং তিন চার হাজার লিটার পানির পাত্র, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর মাধ্যমে আমাদের উপকূলীয় তিনটি উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য ৫০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প সরকার গ্রহণ করেছে।